প্রত্যেক ব্যক্তিরই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকার রয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি একটি সাংবিধানিক অধিকারের বিষয়।ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা মৌলিক অধিকারের ভিতরেও পড়ে। ইসলামী শরীয়তও ব্যাক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি অনেক গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করেছে।সুতরাং আজ আমি আপনাদের সামনে বিষয়টি কোরআন ও হাদীসের আলোকে উপস্থাপন করব।
ভূমিকাঃ পবিত্র কোরআনের সূরা আন-নূরের ২৭ নং আয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি ইসলামী শরীয়ত ও মুসলিম সমাজের নিয়মনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং বিষয়টি অন্যের গৃহে প্রবেশের নিয়মাবলীর দ্বারা সূচনা হয়ে সামাজিকজীবনের নানামুখী বিষয়াবলীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ব্যাপকতা লাভ করেছে।
একজন নারী সহাবী রসূলে কারীম সা. এর নিকটে হাজির হয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! আমি আমার ঘরে এমন অবস্থায় থাকি যে, তখন আমাকে সে অবস্থায় কেউ দেখতে পাক তা আমি মোটেই পছন্দ করি না, সে আমার ছেলে সন্তানই হোক অথবা পিতা হোক, অথচ এঅবস্থায়ও তারা আমার ঘরে প্রবেশ করে। এখন আমি কী করব? এরপরই নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ بُیُوْتِكُمْ حَتّٰى تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤى اَهْلِهَا١ؕ ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ হে ঈমানদারগণ! নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের সম্মতি লাভ করো এবং তাদেরকে সালাম করো। এটিই তোমাদের জন্য ভালো পদ্ধতি, আশা করা যায় তোমরা এদিকে নজর রাখবে। (সূরা আন নূর :২৭)
বস্ত্তত আয়াতটিতে মুসলিম নারী-পুরুষের পরস্পরের ঘরে প্রবেশ করার প্রসঙ্গে এক স্থায়ী নিয়ম পেশ করা হয়েছে। মেয়েরা নিজেদের ঘরে সাধারণত খোলামেলা অবস্থায়ই থাকে। ঘরের অভ্যন্তরে সব সময় পূর্ণাঙ্গ আচ্ছাদিত করে থাকা মেয়েদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় কারো ঘরে প্রবেশ করা চাই সে মুহাররম ব্যক্তিই হোক না কেন তা মোটেই সমীচীন নয়। আর গায়র মুহাররম পুরুষের প্রবেশ করার তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কেননা বিনানুমতিতে ও আগাম না জানিয়ে কেউ যদি কারো ঘরে প্রবেশ করে তাহলে ঘরের মেয়েদেরকে অপ্রস্ত্তত অবস্থায় দেখার এবং তাদের দেহের যৌন অঙ্গের উপর নজর পড়ে যাওয়ার খুবই সম্ভবনা রয়েছে। তাদের সঙ্গে চোখাচোখি হতে পারে। তাদের রূপ-যৌবন দেখে পুরুষ দর্শকের মনে যৌন লালসার আগুন জ্বলে উঠতে পারে। আর তারই পরিণামে এ মেয়ে-পুরুষের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে গোটা পরিবারকে তছনছ করে দিতে পারে। মেয়েদের যৌন অঙ্গ ঘরের আপন লোকদের দৃষ্টি থেকে এবং তাদের রূপ-যৌবন ভিন পুরুষের নজর থেকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা পেশ করা হয়েছে।
জাহেলী যুগে আরববাসীদের নিয়ম ছিল, তারা حَيِّيتٌم صَبَاحًا , حُيِّيتُم مسا (সুপ্রভাত, শুভ সন্ধ্যা) বলতে বলতে নিঃসংকোচে সরাসরি একজন অন্যজনের গৃহে প্রবেশ করে যেতো। অনেক সময় বহিরাগত ব্যক্তি গৃহমালিক ও তার বাড়ির মহিলাদেরকে বেসামাল অবস্থায় দেখে ফেলতো।
মেয়েদেরকে সামলে নেবারও কোন সময় দেয়া হত না। ফলে কখনো ঘরের মেয়ে পুরুষকে একই শয্যায় কাপড় মুড়ি দেয়া অবস্থায় দেখতে পেত, মেয়েদেরকে দেখত অসংবৃত বস্ত্রে।
আল্লাহ এর সংশোধনের জন্য এ নীতি নির্ধারণ করেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির যেখানে সে অবস্থান করে সেখানে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (Privacy) রক্ষা করার অধিকার আছে এবং তার সম্মতি ও অনুমতি ছাড়া তার এ গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা অন্য ব্যক্তির জন্য জায়েয নয়। এ হুকুমটি নাযিল হবার পর নবী ﷺ সমাজে যেসব নিয়ম ও রীতি-নীতির প্রচলন করেন।
নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এ অধিকারটিকে কেবলমাত্র গৃহের চৌহদ্দীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং একে একটি সাধারণ অধিকার হিসেবে গণ্য করেন। এ প্রেক্ষিতে অন্যের গৃহে উঁকিঝুঁকি মারা ও বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা, বাহির থেকে চেয়ে চেয়ে দেখা, এমনকি অন্যের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী তথা চিঠি-ডায়েরী তার অনুমতি ছাড়া পড়ে ফেলা, ফোন-পিসির গ্যালারি,ইমেইল-জিমেইল ইত্যাদিতে প্রবেশ করা সবই নিষিদ্ধ।
আসুন বিষয়গুলো বিস্তারিত জেনে নেই:
১। কারো ঘরে-বাসায় বা ব্যক্তিগত রুমে প্রবেশের পূর্বে কী করতে বলে ইসলামী সমাজ বিধান?
উত্তরঃ প্রথমে সালাম দেওয়া। কারো রুমে বা গৃহে প্রবেশের প্রধান দুটি কাজ রয়েছে ১. সালাম দেওয়া। জবাব না পেলে তিনবার পর্যন্ত সালাম দেওয়া। তারপরেও সালামের জবাব না পেলে ভিতরে প্রবেশ না করে ফেরত আসা। ২.আর সালামের জবাব পেলে ঘরে বা রুমে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে নিতে হবে। হাদীস শরীফে যেরূপ বলা হয়েছে-
আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। নাবী কারীম ﷺ বলেছেন: ‘‘হে প্রিয় পুত্র, তুমি যখন তোমার ঘরের লোকদের সামনে যেতে চাইবে, তখন বাইরে থেকে সালাম কর। এ সালাম করা তোমার ও তোমার ঘরের লোকদের পক্ষে বড়ই বারাকাতের কারণ হবে। (তিরমিজি)
জাবের বর্ণিত হাদীসে রাসূলে কারীম ﷺবললেনঃ
যে লোক প্রথমে সালাম করেনি, তোমরা তাকে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিওনা।
তিনবার অনুমতি চাবার পরও যদি কেউ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়, তবে তারও অনুমতি আছে, কিন্তু শর্ত এই যে, দুরজায় দাঁড়িয়ে বিরামহীন ডাকা-ডাকি ও চিল্লাচিল্লি করতে থাকতে পারবে না।
এ কথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতাংশেঃ
‘তারা যদি ধৈর্যের সহিত অপেক্ষা করত যতক্ষণ না তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছ, তাহলে তাদের জন্যে খুবই কল্যাণকর হত।’’ সূরা হুজরাতঃ ৫)
২। আপন বোন,মেয়ে,ভাতিজি,ভাগ্নী,ফুফু,খালা তথা মাহরাম মেয়েলোকদের কাছে যেতে হলেও প্রথমে অনুমতি চাইতে হবে। এমনকি নিজের মায়ের রুমে প্রবেশ করতে গেলেও সালাম দিয়ে ঢুকতে হবে।আর নিজ স্ত্রীর রুমে ঢুকতে গেলেও সালাম ও অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা উত্তম।
আবূ মূসা আশ‘আরী ও হুযায়ফা বলেছেনঃ اَسْتاْذَنُ عَلى ذَوَاتِ الْمَحَارِمِ কেবলমাত্র অন্যের গৃহে প্রবেশ করার সময় অনুমতি নেবার হুকুম দেয়া হয়নি। বরং নিজের মা-বোনদের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি নিতে হবে। এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি আমার মায়ের কাছে যাবার সময়ও অনুমতি চাইবো? জবাব দিলেন, হ্যাঁ। সে বললো, আমি ছাড়া তাঁর সেবা কারার আর কেউ নেই। এক্ষেত্রে কি আমি যতবার তাঁর কাছে যাবো প্রত্যেক বার অনুমতি নেবো? জবাব দিলেন ‘তুমি কি তোমার মাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পছন্দ কর?
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের উক্তি হচ্ছে, واخواتكم নিজেদের মা-বোনদের কাছে যাওয়ার সময়ও অনুমতি নিয়ে যাও। (ইবনে কাসীর)
ইবনে মাসউদ আরো বলেন, এমনকি নিজের ঘরে নিজের স্ত্রীর কাছে যাবার সময়ও অন্ততপক্ষে গলা খাঁকারী দিয়ে যাওয়া উচিত। তাঁর স্ত্রী যয়নবের বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যখনই গৃহে আসতে থাকেন তখনই আগেই এমন কোন আওয়াজ করে দিতেন যাতেন তিনি আসছেন বলে জানা যেতো। তিনি হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে যাওয়া পছন্দ করতেন না। (ইবনে জারীর)
৩। দাঁড়াবেন কোথায়?
কারো ঘরের সামনে গিয়ে প্রবেশের অনুমতির জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে দরজার ঠিক সোজাসুজি দাঁড়ানো সমীচীন নয়।একটু পাশ লেগে দাঁড়াবেন।
দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করবে না। কারণ, নাবী কারীম ﷺ যখন কারো বাড়ি বা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেন, তখন অবশ্যই দরজার দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন না। বরং দরজার ডান কিংবা বাম পাশে সরে দাঁড়াতেন এবং সালাম করতেন। আবু দাউদ
৪। কারো রুমের বা ঘরের ভিতরে গৃহকর্তার অগোচরে তাকানো নিষেধ। হযরত সওবান (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আজাদ করা গোলাম) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম ﷺ বলেনঃ اذا دخل البصر فلا اذن দৃষ্টি যখন একবার প্রবেশ করে গেছে তখন আর নিজের প্রবেশের অনুমতি নেবার দরকার কি?
অর্থাৎ অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করা আর বাহির থেকে ভিতরে দৃষ্টিপাত করা উভয়টিই সমান।
এক ব্যক্তি রসূলে কারীমের বিশেষ কক্ষপথে মাথা উঁচু করে তাকাল। রসূলে কারীম ﷺ তখন ভিতরে ছিলেন এবং তাঁর হাতে চাকুর মত একটি জিনিস ছিল। তখন তিনি বললেনঃ এ ব্যক্তি বাইরে থেকে উঁকি মেরে আমাকে দেখবে তা আগে জানতে পারলে, আমি আমার হাতের এ জিনিসটি দ্বারা তার চোখ ফুটিয়ে দিতাম।
এ সম্পর্কে আবূ হুরাইরাহ রাযি. থেকে আরো স্পষ্ট ও কঠোর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নাবী কারীম সা. বলেছেনঃ কেউ যদি তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে তাকায়, আর তুমি যদি পাথর মেরে তার চোখ ফুটিয়ে দাও, তাহলে তাতে তোমার কোন দোষ হবে না। এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘যে ব্যক্তি কারোর ঘরে উঁকি মারে এবং ঘরের লোকেরা তার চোখ ছেঁদা করে দেয়, তবে তাদের কোন জবাবদিহি করতে হবে না। এটি এমন অবস্থায় প্রযোজ্য যখন কোন ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে গৃহ মধ্যে প্রবেশ করে, গৃহবাসীদের বাধা দেয়ায়ও সে নিরস্ত হয় না এবং গৃহবাসীরা তার প্রতিরোধ করতে থাকে। এ প্রতিরোধ ও সংঘাতের মধ্যে যদি তার চোখ ছেঁদা হয়ে যায় বা শরীরের কোন অংগহানি হয় তাহলে এজন্য গৃহবাসীরা দায়ী হবে না। (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩য় খণ্ড, ৩৮৫ পৃষ্ঠা) এর থেকে প্রতীয়মান যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় কেউ হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ করলে তা ইসলামে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
৫। অগোচরে অন্যের গৃহে যেমন তাকানো নিষেধ অনুরূপ অন্যের চিঠিপত্র, মেসেঞ্জার, ইমেইল-জিমেইল ও ফোন-পিসির গ্যালারী ও ডকুমেন্টস অনুমতি ছাড়া পড়া ও দেখা নিষেধ।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেছেনঃ مَنْ نَظَرَ فِى كِتَابِ أَخِيهِ بِغَيْرِ إِذْنِهِ فَإِنَّمَا يَنْظُرُ فِى النَّارِ “যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া তার পত্রে চোখ বুলালো সে যেন অগ্নির মধ্যে দৃষ্টি ফেলল (আবুদ দাউদ)। এখানে ‘পত্র’ দ্বারা ব্যাপকতা উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ব্যক্তিগত সব ধরণের তথ্যের কথা বলা হয়েছে।
৬। অন্যের কথাও বিনা অনুমতিতে শুনা নিষেধ
ফকীহগণ শ্রবণ শক্তিকেও দৃষ্টিশক্তির হুকুমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যদি বিনা অনুমতিতে আসে তাহলে তার দৃষ্টি পড়বে না ঠিকই কিন্তু তার কান তো গৃহবাসীদের কথা বিনা অনুমতিতে শুনে ফেলবে। এ জিনিসটিও দৃষ্টির মতো ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারে অবৈধ হস্তক্ষেপ।
সেজন্যে কারো ঘরের দেয়ালে, দরজা-জানলায় কান লাগিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনা নিষেধ।
আবার দুজন লোক কথা বলছে তখন আপনি তাদের কাছে ঘেষে তাদের কথাবার্তা শুনতে চাইলে সেটাও অনুচিত। অনুরূপ কারো ফোনের কল রেকর্ড শুনাও নিষেধ। অথবা আপনার ফোন দিয়ে কেউ কথা বলে থাকলে এবং তা রেকর্ড হয়ে গেলে তাও আপনার জন্যে শুনা অনুচিত। তদ্রুপ কারো একান্তবিষয় ছবি বা ভিডিও করে ভাইরাল করা এবং অন্যের শেয়ার করা এরূপ জিনিস দেখা হারাম।
তবে সে ব্যক্তির কার্যকলাপের বিষয়টির সাথে যদি জনস্বার্থ জড়িত থাকে তাহলে জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় ডকোমেন্টস হস্তান্তর করা যেতে পারে। তবে ক্ষতি করা অথবা মানহানী বা হাস্যরসের জন্যে করলে তা অবশ্যই নাজায়েজ ও ঘৃণিত কাজ হবে।
৭। অনুরূপভাবে ধরুন আপনার পাশে বা পার্শ্ববর্তী সিটে কেউ তার ফোনে কিছু করছে বা দেখছে তখন সময় সে ব্যক্তির ফোনের স্ক্রিনে তাকানো আপনার জন্যে অনুচিত।
৮। কার কথায় ঘরে প্রবেশ করবেন আর কার কথায় না?
গৃহমালিক বা গৃহকর্তা অথবা এমন ব্যক্তির অনুমতি গ্রহণযোগ্য হবে—যার সম্পর্কে মানুষ যথার্থই মনে করবে যে, গৃহকর্তার পক্ষ থেকে সে অনুমতি দিচ্ছে। যেমন: গৃহের খাদেম, সিকিউরিটিগার্ড অথবা কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কোন ছোট শিশু যদি বলে, এসে যান, তাহলে তার কথায় ভেতর প্রবেশ করা উচিত নয়।
৯। অনুমতি চাওয়ার ব্যপারে অযথা পীড়াপীড়ি না করা।
অনুমতি না পেলে দরজার ওপর অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা জায়েয নয়। যদি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পর গৃহকর্তার পক্ষ থেকে অনুমতি না পাওয়া যায় বা অনুমতি দিতে অস্বীকার জানানো হয়, তাহলে ফিরে যাওয়া উচিত।
১০। কখন অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন নেই?
শুধুমাত্র এমন অবস্থায় অনুমতি চাওয়া জরুরী নয় যখন কারোর ঘরে হঠাৎ কোন বিপদ দেখা দেয়। যেমন, আগুন লাগে অথবা কোন চোর ঢোকে। এ অবস্থায় সাহায্য দান করার জন্য বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা যায়।
১১। কোন গৃহে প্রবেশের অনুমতি লাগবে না?
তরজমা—তবে তোমাদের জন্য কোন ক্ষতি নেই যদি তোমরা এমন গৃহে প্রবেশ করো যেখানে কেউ বাস করে না এবং তার মধ্যে তোমাদের কোন কাজের জিনিস আছে। (সূরা আন নূর,আয়াত নং ২৯)
এখানে মূলত হোটেল, সরাইখানা, অতিথিশালা, দোকান, মুসাফির খানা ইত্যাদি যেখানে লোকদের জন্য প্রবেশের সাধারণ অনুমতি আছে সেখানকার কথা বলা হচ্ছে।
১২। নাবালক সন্তান ও দাসদাসী-গৃহখাদেম যাদের জন্যে সাধারণ অনুমতি রয়েছে তাদের জন্যেও তিনটি সময়ে প্রবেশ নিষিদ্ব।
আল্লাহর বাণী: হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসী এবং তোমাদের এমন সব সন্তান যারা এখনো বুদ্ধির সীমানায় পৌঁছেনি, তাদের অবশ্যি তিনটি সময়ে অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিতঃ ফজরের নামাযের আগে, দুপুরে যখন তোমরা পোশাক খুলে ফেল এবং এশার নামাযের পর। এ তিনটি তোমাদের গোপনীয়তার সময়। এরপরে তারা বিনা অনুমতিতে এলে তোমাদের কোন গুনাহ নেই এবং তাদেরও না। তোমাদের পরস্পরের কাছে বারবার আসতেই হয়।এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিজের বাণী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন ও বিজ্ঞ। (আলকোরআন, সূরা নূর)
ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্পর্শকাতর বিষটি সুরক্ষার জন্য এখানে এসে আরোও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ইসলামী শরীয়ত। বলা হয়েছে নাবালক সন্তান ও চাকর বাকররাও এ তিনটি সময়ে রুমে ঢুকতে চাইলে অনুমতি নিতে হবে।
একান্তে অবস্থান করার সময় যেমন আপন ছেলেমেয়েদের হঠাৎ এসে যাওয়া সঙ্গত নয় তেমনি দাসী/চাকরানীর এসে যাওয়াও সঙ্গত নয়। এ আয়াতের আদেশটি প্রাপ্ত বয়স্ক-অপ্রাপ্ত বয়স্ক উভয় ধরনের দাস-দাসীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
উদ্দেশ্য হচ্ছে, যতদিন ঘরের ছেলে মেয়েরা যৌন চেতনা জাগ্রত হবার বয়সে পৌঁছে না ততদিন তারা এ নিয়ম মেনে চলবে। কাজেই উক্ত তিন সময় তথা ফজরের পূর্বে, দুপুরে ও ইশার পর অর্থাৎ শুয়ার পর তারা যখন তোমাদের নির্জন স্থানে আসতে চায় তখন তাদের পূর্বাহ্ণে অনুমতি নেবার নির্দেশ দাও।
১৩। উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে ছোট্ট শিশুদের থেকেও ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যাতে তারা ছোট বয়সেই ইসলামী সমাজের রীতিনীতির এই বিষয়গুলো শিখে নেয়।এবং তাদের মস্তিষ্কে প্রাপ্তবয়স্কদের কোনরূপ কার্যকলাপের চিত্র ঘুরপাক না খায় এবং এই বিষয়গুলোর প্রতি উৎসাহী হয়ে না উঠে। তাই সন্তানের সামনে নিজেরা কাপড় পরা/বদলানো থেকে বিরত থাকুন।জাগ্রত শিশু সন্তানের সামনে যৌন মিলন থেকেও বিরত থাকুন এবং যত্র-তত্র উলঙ্গ অবস্থা থেকে বিরত থাকুন। তাদের কাছে ইসলাম নির্দেশিত সতর সমূহ ঢেকে রাখুন।
১৪। সন্তানরা বালেগ হয়ে গেলে তখন আর অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই।
আল্লাহর বাণী: আর যখন তোমাদের সন্তানরা বুদ্ধির সীমানায় পৌঁছে যায় তখন তাদের অনুমতি নিয়ে আসা উচিত যেমন তাদের বড়রা অনুমতি নিয়ে থাকে।(সূরা আননূর)
অর্থাৎ সাবালক হয়ে যায়,ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক ঋতুস্রাব থেকেই তাদের সাবালকত্ব শুরু হয়।
১৫। আমাদের দ্বারা অপর ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অনেকভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে। যেমনঃ অনেক সময় দেখা যায়, কাছের মানুষ সব গোপন বিষয় ফাঁস করে দেয়া। ধরুন কেউ আপনার কাছে বিশ্বাস করে কিছু গোপন তথ্য শেয়ার করেছে কিংবা আপনি তাঁর এমন কিছু ব্যক্তিগত বিষয়ে অবগত হয়েছেন যা প্রকাশ করলে তার ইজ্জতনষ্ট হতে পারে। হঠাৎ তাঁর সাথে আপনার মনোমালিন্য হওয়ায় গোপন বিষয়গুলো বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন কিংবা দেওয়ার হুমকি দিলেন। আবার প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটলে একে অপরকে লাঞ্চিত করার জন্য ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার বিভিন্ন গোপন ছবি বা ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইলও করা হয়। অসৎ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ওয়াশরুমে বা বেডরুমে গোপন ক্যামেরা লাগানো হয়। এজাতীয় বিষয়গুলো শরীয়ত ও রাষ্ট্রীয় আইনে অত্যান্ত নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য কাজ।
১৬। মোট কথা, কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত/ একান্ত স্হান, নিজস্ব বিষয়াদি বা একাকীত্বে অনধিকার প্রবেশ নাজায়ে। কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ্যে প্রকাশ করা যা প্রকাশিত হলে তার জন্য বিব্রতকর হতে পারে অথবা কোন ব্যক্তির সম্পর্কে এমন তথ্যের প্রচারে উৎসাহিত করা যা জনসাধারণকে তার সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে তাও নাজায়েজ। সুতরাং আমারা এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন হলে সমাজের শান্তি-সম্প্রীতি বজায় থাকবে।