শরহে বেকায়া জামাতের কিতাব সমূহ

প্রিয় জ্ঞানপিপাসু পাঠক, আজ আপনাকে শরহে বেকায়ার কিতাব সম্পর্কে ধারণা দেব।
প্রথমত জেনে নেওয়া যাক শরহে বেকায়া কি?

শরহে বেকায়ার পরিচিতি:
শরহে বেকায়া হচ্ছে কওমি মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণী (উচ্চমাধ্যমিক-২/ এইচএসসি / আলিম সমময়ান)। যাকে মুখতাসার জামাত এবং সানবিয়্যাহ উলইয়া বলা হয়।

শরহে বেকায়া বা সানাবিয়া উলইয়া জামাতটি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ এর অন্তর্ভুক্ত। বোর্ডকর্তৃক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। শরহে বেকায়া পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করতে সক্ষম হলে একজন শিক্ষার্থী ইলমে দ্বীনের প্রকৃত স্বাদ লাভ করতে শুরু করে।

শরহে বেকায়া জামাতে যে বিষয়গুলো পড়ানো হয়/ শরহে বেকায়ার সিলেবাস:
১. আরবি সাহিত্য (প্রাচীন ও আধুনিক) ২. ইনশা (রচনা) ৩ . আল অরুজ (আরবি কবিতা শাস্ত্র) ৪. বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) ৫ . তাফসিরুল কোরআন ৬. ফিকহ ( আইন শাস্ত্র ) ৭. উসুলুল ফিকহ (ইসলামি আইনের নীতি শাস্ত্র ) ৮. ইলমে ফরায়িজ (পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টন নীতি)

১। শরহে বেকায়া ১ম খন্ড (المجلد الأول من شرح الوقاية)
২। শরহে বেকায়া ২য় খন্ড (المجلد الثاني من شرح الوقاية)

শরহে বেকায়ার সম্মানিত লেখকের নাম : উবায়দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রহমতুল্লাহ।
শরহে বেকায়া গ্রন্থটি হিজরি সপ্তম শতকের শেষার্ধে আরবি ভাষায় রচিত ফিকহে হানাফির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি মূলত শায়খ বুরহানুশ শরীআহ, মাহমুদ রহ: এর রচিত ‘বিকায়া’ গ্রন্থের শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ। এই শরহে বিকায়া ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় ‘বিকায়া’ গ্রন্থের ২০টিরও বেশি ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে শরহে বিকায়া-ই সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান। ‘শরহে বেকায়া’ গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব হওয়ায় এর নামানুসারে এ ক্লাসটির নাম ‘শরহে বেকায়া’ রাখা হয়। শরহে বেকায়া কিতাবটিকে দুইভাগ করে দরস দেয়া হয়। প্রথম ভাগ কিতাবুত ত্বহারাত থেকে কিতাবুল হজ্জ পর্যন্ত। দ্বিতীয়ভাগ কিতাবুন নিকাহ থেকে শেষ পর্যন্ত।

৩। মুখতাসারুল মাআনী مختصر المعاني
কিতাবটি ইলমে বালাগাত (অলঙ্কারশাস্ত্র) বিষয়ে রচিত। লেখক: আল্লামা সাদুদ্দীন তাফতাযানী রহ: (৭২২-৭৯২ হিজরি)।  আল্লামা তাফতাযানী ছিলেন তাঁর যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইলমের প্রতিটি শাখায় তাঁর বুৎপত্তি ছিল অসাধারণ ও অতুলনীয়। তিনি তাঁর জ্ঞানকে উত্তরসুরীদের মাঝে রেখে যাওয়ার জন্যে বহু কিতাব রচনা করেছেন। তাঁর কিতাব ও ইলমের মাধ্যেমে জ্ঞানের জগতে অমর হয়ে আছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কিতাব হল মুখতাসারুল মাআনী। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা কারিকুলামের অতিগুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কিতাব মুখতাসারুল মায়ানী। এটি মুতাওয়াল কিতাবের সংক্ষেপ। এজন্যে বলা হয় মুখতাসার। এতে রয়েছে—ইলমুল মাআনী, ইলমুল বয়ান, ইলমুল বাদী। কিতাবটির বৈশিষ্ট হল— تشبيه، استعارة، كناية، وفيه نظر ইত্যাদি।
কিতাবটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এই জামাতের নাম জামাতে মুখতাসারও বলা হয়।

৪। কুরআন তরজমা ترجمة القرأن
শরহে বেকায়া জামাত পর্যন্ত কুরআনুল কারীমের তরজমা পড়ানো হয়। পারা নম্বর ০১ থেকে ১৫ পারা পর্যন্ত বাংলা অনুবাদ পড়ানো হয়। শরহে বেকায়া পর্যন্তই কুরআনুল কারীমের তরজমা পড়ানো হয়ে থাকে। এরপর থেকে তাফসীর পড়ানো হয়৷ তরজমা পড়ানো ক্ষেত্রে কুরআনের শব্দাবলীর দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। নতুন বা অপরিচিত শব্দ আসলে তার তাহকীক বিশ্লেষণ করা হয়। পাশাপাশি দুর্বোধ্য আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসীরও করা হয়। তরজমার জন্যে কোথাও মারিফুল কুরআন বা তাওযিহুল কুরআনের সহযোগিতা নেওয়া হয়।

৫। মাকামাতে হারীরী (আরবি সাহিত্য) المقامة الحريري, লেখক: মাকামাতে হারীরীর সম্মানীত লেখকের নাম : আবু মুহাম্মদ আল কাসিম ইবনে আলী আল হারিরী আল বসরী।
প্রাচীন আরবি গদ্য সাহিত্যের স্বীকৃত সাহিত্যমানসম্পন্ন একটি অনবদ্য গ্রন্থ মাকামাতে হারীরী। আধুনিক আরবি সাহিত্যের অনুপ্রাসহীন স্বচ্ছন্দ গতির রীতি-ধারা প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হারীরী আরবি সাহিত্যের লেখক ও পাঠক সমাজকে শুধু প্রভাবান্বিতই করেননি; বরং এক রকম মন্ত্রমুগ্ধ ও মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন বহু শতাব্দীকাল যাবৎ। এ সময় তাঁর অনুকরণবিহীন সাহিত্যের পক্ষে স্বীকৃতির সনদ পাওয়া ছিল খুবই কঠিন। হারীরী আরবি সাহিত্যের এ অনুপ্রাসময় রীতির প্রবর্তক বা পথিকৃত না হলেও তিনি যে অগ্রণী অনুসৃত এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর মাকামাতের অনুকরণে বহু মাকামাত রচিত হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই হারীরীর মাকামাতের মানে উত্তীর্ণ ও স্বীকৃত হয়নি। হারীরীর মাকামাত গ্রন্থখানি রচিত হওয়ার পর থেকে নয়শ’ বছরের অধিককাল যাবৎ এটি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। এ দীর্ঘ সময়ে লাখো আরবি শিক্ষার্থীর সাহিত্য প্রতিভা বিনির্মাণে এ গ্রন্থখানি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে এবং অজস্র মনীষার জন্ম দিয়েছে, যারা পরবর্তীতে আরবি রচনা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে কালজয়ী অবদান রেখেছেন। এ কারণে গুরুত্বের সাথে গ্রন্থখানির পাঠদান ও পাঠগ্রহণ করা হয়ে থাকে। মাকামাতের গদ্যরীতি ও রচনাশৈলী বর্তমান আরবি সাহিত্যে অনেকটা অপ্রচলিত হলেও তার শব্দমালা তো আর অপ্রচলিত হয়ে যায়নি। কাজেই গ্রন্থখানির আবেদন এবং অবদান – ক্ষমতাও ফুরিয়ে যায়নি। আর কোনো কালে এর আবেদন একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যাবে বলেও মনে হয় না। কারণ মাকামাতে হারীরীতে আনুমানিক ৯০% এরূপ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যেগুলো অবিকলভাবে অথবা তার শব্দমূল পবিত্র কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং কুরআন ও হাদীসের অর্থ ভাষাগতভাবে যথাযথ অনুধাবন করার জন্যও গ্রন্থখানির গুরুত্ব অপরিসীম। অধিকন্তু গ্রন্থখানি আরবি ভাষার অসংখ্য কঠিন শব্দ আয়ত্ত করা ছাড়াও ইলমুন নাহব ও ইলমুল বালাগাতের অগণিত নিয়মাবলি চর্চার একটি সমন্বিত সহজ অবলম্বন।

৬। নুরুল আনওয়ার (উসূলে ফিকহ) نور الأنوار নুরুল আনোয়ার কিতাবটি মূলত আল মানার কিতাবের শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ। উসূলুল ফিকহের উপর লিখিত এ অসাধারণ গ্রন্থটি বিশ্বের আলেম সমাজের নিকট সমভাবে সমাদৃত। কিতাবটি রচনা করেছেন আল্লামা আহমদ ইবনে সাঈদ মোল্লাজিউন রহ: (১০৪৮-১১৩০ হিজরি)। ফিকহি মাসআলার মান যাচিয়ের জন্যে উসূলে ফিকহের বিকল্প নেই। মুজতাহিদ ফুকাহায়ে কেরাম নিজনিজ ইজতিহাদ অনুযায়ী বিভিন্ন মাসআলা বের করেছেন।আর ইজতেহাদী মাসায়িল বর্ণনা করা কোনো নীতিমালার অনুসরণ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই কওমি মাদ্রাসাসহ বিশ্বের সমস্ত দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত গুরুত্বেরসহিত এই কিতাবটি পাঠিদান করা হয়। এই কিতাবটিতে শরীয়তের চার উৎস তথা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসের বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই কিতাবটি দুইভাগ করে পাঠদান হয়। একভাগ জামাতে কাফিয়া/শরহে জামিতে,আপরভাগ শরহে বিকায়া জামাতে।

৭। সিরাজি (মীরাস/ ইলমে ফারায়িজ) سراجي
সিরাজী কিতাবটি ফারায়েয তথা মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি বন্টন বিষয়ক প্রামাণ্যগ্রন্থ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইলমে ফারায়িযকে  ইলমের অর্ধেক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং মানুষকে এজ্ঞান অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। সিরাজী কিতাবটির সম্মানিত লেখক হলেন: আফগানিস্তানের অধিবাসী হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর যুগশ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা আবু তাহের সিরাজুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রশীদ রহিমাহুল্লাহ।
কুরআন- হাদীসে বর্ণিত শরঈ আহকাম দুই প্রকার । (১) আল্লাহর হক সংক্রান্ত , (২) বান্দার হক সংক্রান্ত। বান্দার হককে তিনভাগে বিভক্ত করা হয় (১) পারিবারিক বিষয় সংক্রান্ত বিধি-বিধান। যথা : বিবাহ , ওয়ারিশী স্বত্ব ইত্যাদি। (২) পারস্পরিক লেনদেন সংক্রান্ত বিধিবিধান। যথা- ক্রয় – বিক্রয়, ইজারা, হেবা ইত্যাদি। (৩) রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত হুকুম আহকাম। যথা : রাষ্ট্রীয় চুক্তি-পত্র, কর, দন্ডবিধি, জনকল্যাণমূলক কার্যাবলীর মাসয়ালা মাসায়িল ইত্যাদি।
এসব বিষয়বস্তুর মধ্যে মধ্যে ইলমূল ফারায়েয তথা মৃতের ত্যাজ্য সম্পদ বন্টন শাস্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। তদুপরি জটিল হিসাব-নিকাশ এবং মাসআলা-মাসায়েল সম্বলিত হওয়ায় এটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ।মুসলিম সমাজে সর্বদাই এ বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হত। আর এ বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত শরীয়ত সম্পদ বন্টন কার্য সম্পন্ন করা অসম্ভব। এ কারণে এই বিষয়টি মুসলিম বিশ্বের সকল ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য সূচীর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফারায়েয বিষয়ে সিরাজী গ্রন্থখানা সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য এবং সমাদৃত। বিগত কয়েক শতাব্দি যাবত এই গ্রন্থখানা সকল ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য সূচীর অন্তর্ভুক্ত।

৮। আত ত্বারীকু ইলাল ইনশা ৩য় খন্ড
الطريق الي الإنشاء
আধুনিক শব্দকোষ, রচনাশৈলী ও চিঠিপত্রের কলাকৌশল।  লেখক,  আল্লামা সুলতান যওক নদভী, প্রতিষ্ঠাতা, দারুল মাআরিফ, চট্টগ্রাম।

আরোও পড়ুন: জালালাইন জামাতের কিতাবের তালিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *