জালালাইন জামাতের পরিচিতি:
জালালাই জামাত হলো কওমি মাদ্রাসার
ত্রয়ােদশ শ্রেণী। মিশকাত জামাতের একস্তর নিচে, যাকে হেদায়া জামাতও বলা হয়। জালালাইন জামাতকে স্নাতক-১ বলে বিবেচনা করা হয়। এই শ্রেণীটি বোর্ড অন্তর্ভুক্ত নয়। জালালাইন জামাতের পরীক্ষা নিজনিজ প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বের জামাত ‘শরহে বেকায়া’ এবং এর পরের জামাত ‘মিশকাত’ (বেফাক) বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত। জালালাইন জামাতের সিলেবাস হলো—১. তাফসির ২.ফিকহ ৩. উসুলুল ফিকহ ৪. মানতিক (তর্ক শাস্ত্র) ৫. উসুলুত তাফসির (তাফসীরের মূলনীতি ৬. আরবি সাহিত্য ৭. ইসলামি অর্থনীতি ৮. ইলমে হিকমাত (দর্শন শাস্ত্র) ৯. ইলমুল কালাম (আকীদা বিষয়ক শাস্ত্রজ্ঞান)।
জালালাইন জামাত বা হেদায়া জামাতের মতন:
১। তাফসীরে জালালাইন ১ম খন্ড
২। তাফসিরে জালালাইন ২য় খন্ড
(تفسیر الجلالین) তাফসীরে জালালাই
কুরআনুল কারীমের একটি সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ; যার অনন্য বৈশিষ্ট্যে পাঠক মহলে সমাদৃত।
তাফসিরে জালালাইন এর লেখক এর পরিচিতি: তাফসিরে জালালাইন মূলত দুজন মুফাসসীরের যৌথ রচনা। মজার বিষয় হলো— তাঁদের উভয়জনের নামই ছিল জালাল। একজনের নাম- জালালুদ্দিন মহল্লী। অপরজনের নাম ছিলো- জালালুদ্দিন সুয়ূতি। পরবর্তীতে ‘ তাফসিরে জালালাইন’ (দুই জালালের তাফসির) নামকরণ করা হয়। এ কিতাবটির নামেই ‘জামাতে জালালাইন’ নামকরণ করা হয়েছে। এর আলোকে সহজভাবে তাফসীরের মূলনীতি শিক্ষা করা যায়।
৩। আশরাফুল হেদায়া ১ম খন্ড
৪।আশরাফুল হেদায়া ২য় খন্ড
হিদায়া হানাফী মাযহাবের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, নির্ভরযোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রামাণ্য ফিকাহ্ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের প্রণেতা ইমাম বুরহান উদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবৃ বকর ৫১১ হিজরী মোতাবেক ১১১৭ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের মারগীনান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ৫৯৩ হিজরী মোতাবেক ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তিকাল করেন। অসাধারণ প্রতিভাধর বুরহান উদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবূ বকর (র) ছিলেন একাধারে হাফেজে কুরআন, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকীহ্ এবং নীতিশাস্ত্রবিদ। হিজরী ষষ্ঠ (দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ) শতকে রচিত এই গ্রন্থটির বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা লেখকের ব্যাপক ও গভীর পাণ্ডিত্য, ফিকাহ্ শাস্ত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ও পারদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে। বুরহান উদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবূ বকর (র)-এর সুদীর্ঘ ১৩ বছরের পরিশ্রমের ফসল এই ‘আল-হিদায়া’ই তাঁকে বিশ্বের দরবারে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে তিনি তাঁর এই গ্রন্থটিতে অতি নিপুণভাবে সংক্ষিপ্ত বাক্যে গভীর ও ব্যাপক ভাব প্রকাশ করেছেন। আল – হিদায়া ইসলামী আইন শাস্ত্রের একখানি নির্ভরযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ। গ্রন্থকার বুরহান উদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবূ বকর (র) তাঁর এই গ্রন্থখানিতে ইসলামী আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায়, ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য ইমামের মতামত, দলিল প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন। হানাফী মাযহাবের রায় ও সিদ্ধান্তসমূহ পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করে এ সবের সমর্থনে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের এমন সব অকাট্য প্রমাণ পেশ করেছেন, যাতে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত এবং রায়সমূহই সঠিক, অধিক গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত প্রমাণিত হয়েছে। গ্রন্থখানিতে কোথাও ইমাম আবূ হানীফা (র), কোথাও ইমাম আবূ ইউসুফ (র) এবং কোথাও ইমাম মুহাম্মদ (র) -এর সিদ্ধান্তকে যুক্তি-প্রমাণসহ প্রাধান্য প্রদান করা হয়েছে। হেদায়া গ্রন্থটি পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মূল্যবান গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করে চার খণ্ডে প্রকাশ করেছে। এর প্রথম খণ্ডটি ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের সাথে সাথে এর সকল কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। হেদায়ার প্রথম দুই খন্ড জালালাইন জামাতে দরস দেয়া হয়। আর শেষ দুই খন্ড মিশকাত জামাতে দরস দেয়া হয়।
৫। লামিয়াতুল মুজিযাত
আরবি সাহিত্যের কিতাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একশত মুজিযা সম্বলিত কাসীদা (কবিতা)। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় মাদরাসায় লামিয়াতুল মুজিযাত পাঠ্যতালিকায় রয়েছে। গ্রন্থকারের জীবনী: নাম ও জন্মগ্রহণ : লামিয়াতুল মু’জিযাতের গ্রন্থকারের নাম- ফখরুল ওলামা, যুবদাতুল কুমালা, তাজুল উদাবা, হযরতুল আল্লাম মাওলানা হাবীবুর রহমান ইবনে হযরত মাওলানা ফযলুর রহমান দেওবন্দী (র .)। তিনি সাহরান পুরের নিকটবর্তী দেওবন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সম্মানিত পিতা হযরত মাওলানা ফযলুর রহমান (র .) দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্য হতে অন্যতম। তিনি সাহিত্যিকতায় সুদক্ষ এবং গদ্য ও পদ্য উভয়ের মধ্যে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। কয়েকটি অত্যধিক উপকারী রচনা তাঁর চিরস্থায়ী ও সর্বাধিক স্মৃতি বহন করে। দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসার সুবিখ্যাত লেখকদের মধ্য হতে তিনি পঞ্চম স্থানের অধিকারী ছিলেন। ‘লামিয়াতু মুজিযাত’ রাসূল -এর জীবনী ও মু’জিযাতের উপর অতুলনীয় কিতাব, যার দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্তও পরিদৃষ্ট হয়নি। ইন্তেকাল : তিনি ১৩৪৭ হিজরি সনে ইহকাল ত্যাগ করে পরকালের বাসিন্দা হন।
৬। দেওয়নাতুল মুতানাব্বী
আরবি সাহিত্যের কিতাব বা আদবের কিতাব।
দেওয়ানুল মুতানাব্বীর লেখক হলেন: আহমদ ইবনে হুসাইন ইবনে আব্দুস সামাদ আবু তায়্যিব মুতানাবী (৯১৫-৯৬৫)। আরবি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। এ গ্রন্থখানা আরবি সাহিত্যের জগতে একটি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ। দীওয়ানুল মুতান্নাবী গ্রন্থে ১৯৬টি শের রয়েছে।
কোনো কোনো মাদ্রাসার জালালাইন জামাতে আরবি সাহিত্যের কিতাব হিসেবে ‘লামিয়াতুল মুজিযাত’ পড়ানো হয়, আবার কোথাও দেওয়ানুল মুতানাব্বী পড়ানো হয়। আবার কোথাও উভয়টিই পড়ানো হয়।
৭। আল ফাউযুল কাবীর (ফী উসূলিত তাফসীর)।
আল ফাউজুল কাবীর কিতাবটি কুরআন ব্যাখ্যার মূলনীতি বা তাফসীরের মূলনীতি সংক্রান্ত। এর সম্মানিত লেখকের নাম: শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী রহ:। শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী রহ ছিলেন ভারতের প্রতিভাবান ব্যক্তিদের একজন ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের অন্যতম। কিতাবটির মাধ্যমে নির্ভুলভাবে কুরআনের তাফসির করার মতো যোগ্যতা অর্জন হয়।
৮। আকীদাতুত ত্বহাবী (আকীদা বিষয়ক শাস্ত্রজ্ঞান)।
লেখক: ইমাম আবু জাফর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সালামা আত ত্বহাবী। তাঁর নামের সাথে সম্পৃক্ত করেই ‘আকীদাতুত তহাভী’ নামকরণ করা হয়েছে।
কিতাবটিতে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ, তাঁর গুণাবলি ও তার সম্পর্কিত অন্যান্য আকীদা এবং রাসূল সাঃ এর সম্পর্কে সঠিক আকীদা কি হবে সেসংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামি শরীয়তের মৌলিক বিধিবিধানগুলোর ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকার জন্যে এ কিতাবটি পড়া অনেক জরুরি।
আরো পড়ুন: শরহে বেকায়ার কিতাব পরিচিতি
প্রিয় পাঠক, এ ছিল আমাদের জালালাইন জামাতের কিতাব পরিচিতি।