কাদিয়ানীদের ইতিহাস, কাদিয়ানী কাকে বলে? কাদিয়ানিরা অমুসলিম কেন?

কাদিয়ানীদের ইতিহাস, কাদিয়ানী কাকে বলে? কাদিয়ানিরা অমুসলিম কেন?

সম্মানিত দ্বীন সচেতন পাঠক! আজকের পোস্ট থেকে আমরা জানব — কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে। কাদিয়ানীদের ইতিহাস, কাদিয়ানীদের পরিচয়, কাদিয়ানি কাকে বলে? কাদিয়ানী কারা? আহমদিয়া মুসলিমা জামাত কি? কাদিয়ানিরা অমুসলিম কেন বা কাদিনী কাফের কেন? বাংলাদেশের কাদিয়ানী ও কাদিয়ানীদের বর্তমান অবস্থা? আদালত, পার্লামেন্ট, সরকার ও রাবেতা আলম আল ইসলামী কর্তৃক কাদিয়ানীরা কাফের হওয়ার স্বীকৃতি ইত্যাদি।


যুগে যুগে যেসমস্ত ভ্রান্ত দলের উদ্ভব হয়েছে সেসবের মধ্যে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া একটি।

কাদিয়ানি বা আহমদিয়া ইসলাম ধর্মের বিপরীতে আলাদা একটি নতুন ধর্ম। বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে তা ইসলামের লেবেল লাগিয়ে চলছে। প্রতারিত হচ্ছে দ্বীন সম্পর্কে অচেতন সাধারণ মুসলমান।

ধর্মের নাম: কাদিয়ানী বা আহমদীয়া। পুরো নাম: আহমদিয়া মুসলিম জামাত। আহমদিয়া মুসলিমা জামাতের প্রতিষ্ঠাতা: মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। সে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের কাদিয়ান নামক স্হানে ১৮৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করে। নিজেকে প্রতিশ্রুত মসীহ, মাহদি ও নবী দাবি করে। পবিত্র কুরআনের অনেকগুলো আয়াত ও হাদিস অস্বীকার করে। ১৮৮৯ সালে সে কাদিয়ানি বা আহমদিয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে। তার অনুসারীদের কাদিয়ানী বা আহমদীয়া বলা হয়। সারা বাংলাদেশে কাদিয়ানীদের ১০৩টি শাখা রয়েছে। আর ৪২৫টি জায়গায় কাদিয়ানীদের বসবাস ও ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। ‘আহমদী’ নামে পাক্ষিক পত্রিকা বের হয়। তারা সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করছে। এই মুসলমানদেরকে কাদীয়ানীদের প্রতারণা থেকে বাঁচানোর জন্য উলামায়ে কেরাম অক্লান্ত চেষ্টা-পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪:৩৫ পার্লামেন্টের সকল সদস্যদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে কাদিয়ানীদের উভয় গ্রুপকে কাফের ঘোষণা দেওয়া হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল ইয়াহইয়া বখতিয়ারকে
প্রথমে মুখপাত্র বানানো হয়, আর জেরা করার জন্য ডাকা হয় মির্জা নাসেরকে, যে কাদিয়ানীদের তৃতীয় খলিফা এবং মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানীর পৌত্র ছিল। দীর্ঘ ১৩ দিন জেরা চলে, সেই জেরায় উঠে আসে মির্জা কাদিয়ানীর কুৎসিত সব বক্তব্য ও উদ্ভট নোংরা দাবিসমূহ। যা শুনে পার্লামেন্টের সেক্যুলার সদস্যরাও বিস্মিত হয়েছিলো। যেমন-মির্জা কাদিয়ানী কর্তৃক সকল মুসলমানদেরকে কাফের বলা। নিজেকে ইসলামের নবী দাবি করা। “খানকির বাচ্চা” বলে সকল মুসলমানদেরকে গালি দেওয়া ইত্যাদি ও এজাতীয় কথা সকল পার্লামেন্ট মেম্বারকে হতবাক করেছে। বাস্তবেই কাদিয়ানীদের অন্তর্নিহিত এসকল কথা যদি মুসলমানরা জানে তাহলে সত্যিই বিচলিত হয়ে উঠবে।

এভাবে ১৯৭৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান পার্লামেন্টে কাদিয়ানীদেরকে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের ও সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালের ২৬ এপ্রিল মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। যার অধীনে কাদিয়ানীরা ইসলামী কোন প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না, নিজেদেরকে মুসলমান পরিচয় দিতে পারবে না, নিজেদের ধর্মকে ইসলাম বলতে পারবে না, নিজস্ব ধর্মের প্রচার প্রসার করতে পারবেনা, নিজ উপাসনালয় কে মসজিদ বলতে পারবে না, উপাসনা কে নামাজ বলতে পারবে না।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকের জারিকৃত এই কাদিয়ানী প্রতিরোধ আইনের বিরুদ্ধে চললে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার আইন পাশ করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাদিয়ানীরা ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে শরিয়া আদালতে আপিল করে। কিন্তু আদালত রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হকের অধ্যাদেশকে অক্ষুন্ন রাখে এবং ১৯৮৪ সালের ২৮ শে অক্টোবর কাদিয়ানীদের আপিল খারিজ করে দেয়। এভাবে এর আগে পরে মিলিয়ে কাদিয়ানীরা তাদের স্বউদ্ভাবিত ধর্মের নামে প্রতারণা কে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে কিন্তু প্রতারণার চাদরে ঢাকা ধর্মটি সে পরিচয় লুকাতে পারেনি। ফলে বিচারপতিরা তা সহজেই বুঝতে পেরে কাদিয়ানীদেরকে কাফের বলে সাব্যস্ত
করেছে।

নিচে আমরা তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করছি। এই তালিকায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ব্রিটিশ আমলের কিছু আদালত ও কাদিয়ানীদের কে অমুসলিম বলে ঘোষণা দেয় তার বিবরণ আছে :

১৯৩৫ সাল ৭ জুলাই ভাওয়ালপুর জেলার ডিস্ট্রিক্ট জজ মুন্সি মুহাম্মদ আকবর খান কাদিয়ানীদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে ইসলামের সীমানা থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি জামাত বলে সিদ্ধান্ত দেয়।

১৯৫৪ সাল ২৫ মার্চ মিয়া মোহাম্মদ সেলিম, সিনিয়র সিভিল জজ রাওয়াল পিন্ডি; তাঁর সিদ্ধান্তে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম বলে সাব্যস্ত করেছেন।

১৯৫৫ সাল ৩ জুন রাওয়ালপিন্ডি জেলার এডিশনাল ডিস্ট্রিক জজ তার সিদ্ধান্তে কাদিয়ানীদেরকে কাফের এবং
ইসলামের সীমানা থেকে বের হয়ে যাওয়া জামাত বলে রায় দিয়েছে।

১৯৬৯ সাল ২২ মার্চ শেখ মোহাম্মদ রফিক গিরিযাহ, সিভিল জজ, তার এক সিদ্ধান্তে কাদিয়ানীদেরকে কাফের এবং ইসলামের বাইরের জামাত বলে রায় দেয়। চাই তারা কাদিয়ানী গ্রুপ হোক বা লাহোরি গ্রুপ হোক।

১৯৭২ সালে ভাওয়াল পুরের কমিশনার জনাব মালিক আহমেদ খান কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম এবং উম্মত থেকে পৃথক এক সম্প্রদায় বলে ঘোষণা দেয়।

১৯৭২ সালে রহিম ইয়ার খানের সিভিল জজ চৌধুরী মোহাম্মদ নাসিম সাহেব সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে মুসলমানদের বস্তির মধ্যে কাদিয়ানীদের ধর্ম প্রচারের ও উপসনালয় বানানোর অনুমতি নেই।

১৯৭৩ সাল ২৮ এপ্রিল আজাদ কাশ্মীর এসেম্বলি কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু কাফের বলে বিল পাস করেছিল।

১৯৭৪ সাল ১৯ সীমান্ত প্রদেশের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে পাস করেছিল যে কাদিয়ানীরা অমুসলিম, কাফির।

১৯৭৪ সাল ২৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে কাদিয়ানীদের কে অমুসলিম সংখ্যালঘু কাফের বলে সিদ্ধান্ত দেয়। এইভাবে আদালত, পার্লামেন্ট, সরকার সকলেই কাদিয়ানীদের ইসলামের নামে
প্রতারণা বুঝতে পেরে অমুসলিম ঘোষণা দেয়।

রাবেতা আলম আল-ইসলামীর পক্ষ থেকে কাদিয়ানীদেরকে কাফের ঘোষণা :
১৩৯৪ হিজরী ১৪ রবিউল আউয়াল থেকে ১৮ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত মক্কা মুকাররমায় একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যার আয়োজন করেছিল রাবেতা আলম আল-ইসলামী, যেখানে ১৪০ টি রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিনিধি সহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও শরীক ছিল। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তা নিম্নরূপ:

কাদিয়ানিয়্যাত বা আহমাদিয়্যাত এমন এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠি, যারা ইসলামের সাইনবোর্ডের অন্তরালে নিজেদের জঘন্য ও নোংরা উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করছে। ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের বিরুদ্ধে তাদের মৌলিক
বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

১. এ দলের প্রতিষ্ঠাতা নবুওতের দাবি করেছে।

২. তারা কুরআনের আয়াত বিকৃতি সাধন করেছে।

৩. তারা জিহাদকে রহিত মনে করে।

কাদিয়ানী ধর্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সৃষ্টি ও তাদের দ্বারা লালিত পালিত। বৃটিশের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তারা উম্মতে মুসলিমার স্বার্থের সাথে খেয়ানত করেছে এবং সাম্রাজ্যবাদী ইহুদীদের স্বার্থের অতন্দ্রপ্রহরী। কাদিয়ানী ধর্ম ইসলামের শত্রুদের থেকে সাহায্য নিয়ে ইসলামী শিক্ষা ও আকিদা কে রহিত করা ও বিকৃত করার ক্ষেত্রে তাদের দোসরদের ভূমিকা পালন করছে। এর জন্য কাদিয়ানীরা যে সকল মাধ্যমকে ব্যবহার করছে তা নিম্নরূপ:

১. ইসলামের শত্রুদের থেকে সহযোগিতা নিয়ে মসজিদ নাম দিয়ে উপাসনালয় নির্মাণ করে সেখানে কাদিয়ানীদের গুমরাহকারী আকিদা ও চেতনার শিক্ষা দেওয়া।

২. স্কুল ও এতিম খানা প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে কাদিয়ানীদের ইসলামবিরোধী অপতৎপরতা শিক্ষা দেওয়া এবং বিভিন্ন লোকাল ও আন্তর্জাতিক ভাষায় কুরআনের বিকৃত অনুবাদ করে তা প্রচার করা।

এসকল হুমকি মোকাবেলা করার জন্য এই সম্মেলন সুপারিশ করছে যে,
১. সমস্ত ইসলামী সংগঠন এই বিষয়ে গুরুত্ব দিবে যে, কাদিয়ানী অপতৎপরতা কেবল তাদের স্কুল-এতিমখানা ও নিজ প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকবে । এছাড়া মুসলমানদেরকে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামী দুনিয়াকে তাদের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক দূরভিসন্ধির ব্যাপারে সতর্ক করবে। ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

২. তাদের কাফের হওয়ার ঘোষণা প্রকাশ্যে দিতে হবে এবং ইসলামের পবিত্র জায়গা সমূহে তাদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।

৩. মুসলমানরা কাদিয়ানীদের সাথে কোন প্রকার লেনদেন করবে না । তাদেরকে সামাজিকভাবে এবং তা’লীমি দিক দিয়ে বয়কট করা হবে। তাদের সাথে বিবাহ-শাদী বর্জন এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাদের দাফন নিষিদ্ধ। তাদের সাথে আচার-আচরণ কাফেরদের মত হবে।

৪. সকল ইসলামী সরকারের কাছে আবেদন, তারা যেন নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীদের প্রতিহত করে, তাদেরকে অমুসলিম ও সংখ্যালঘু বলে চিহ্নিত করে এবং প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব প্রদান না করে।

৫. পবিত্র কোরআনে তাদের বিকৃতি গুলো চিহ্নিত করে এবং তাদের অনুবাদের তালিকা তৈরি করে মানুষকে সে ব্যাপারে সজাগ করতে হবে। এবং তার প্রচার-প্রসারকে থামাতে হবে।
হবে।

৬. ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া অন্য সকল শ্রেণীর কাফেরের মতো কাদিয়ানীদের সাথে আচরণ করতে হবে।


আশা করি আহমদিয়া মুসলিম জামাত বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়, কাদিয়ানী মতবাদ, কাদিয়ানীদের ইতিহাস, কাদিয়ানীদের পরিচয়, কাদিয়ানি কাকে বলে? কাদিয়ানী কারা? কাদিয়ানিরা অমুসলিম কেন বা কাদিয়ানী কাফের কেন? বাংলাদেশের কাদিয়ানী ও কাদিয়ানীদের বর্তমান অবস্থা কি ও তাদের ব্যাপারে আমাদের আকীদা বিশ্বাস কেমন হবে এসব বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেয়েছেন। তাই কাদিয়ানীদের ফিতনা থেকে দূরে থাকুন।আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সরল সহজ পথে পরিচালিত করুন।

তাজুল ইসলাম মিসবাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *