হিফজুল কুরআন
হিফজ বিভাগের রুটিন:
পড়াশোনায় সফলতা অর্জনের জন্য রুটিনের বিকল্প নেই। শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্যে নয়, যেকোনো কাজ রুটিন মাফিক করা হলে তাতে দ্রুত সফলতা আসে। অত্রপ্রবন্ধে আমার আলোচনার বিষয় হল—‘হিফজ বিভাগের চব্বিশ ঘন্টার রুটিন’ সম্পর্কে। একটা শিক্ষার্থীকে যদি তিন-চার বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ হিফজ কমপ্লিট করতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই একটি মানসম্মত রুটিন অনুসরণ করতে হবে।
পৃথিবীতে পড়াশোনার জন্য যত রুটিন তৈরী হয়েছে তন্মধ্যে হিফয বিভাগের রুটিনটি ব্যতিক্রমী ও কষ্টসাধ্য। অন্যান্য পড়াশোনা রুটিন সাধারণত আট থেকে চৌদ্দ ঘন্টার হয়ে থাকে; কিন্তু হিফজ বিভাগের রুটিন দিনের চব্বিশ ঘন্টার সাথেই সম্পৃক্ত। আর হিফজবিভাগের রুটিন এমন এক রুটিন যা ছাত্র শিক্ষক উভয়ের জন্যেই একই রকম। উভয়কেই একই নিয়ম ফলো করতে হয়। যেহেতু কোরআন কোনো সাধারণ গ্রন্থ নয় সুতরাং তাঁর ধারকবাহক হওয়াও সাধারণ বিষয় নয়। তাঁর জন্যে প্রয়োজন কঠোর সাধনা।
প্রিয় পাঠক, হিফজ বিভাগের জন্যে একটি মানসম্মত রুটিন সংকলন করেছি। যে রুটিনটি দেশের অভিজ্ঞ হাফেজ শিক্ষকদের মাধ্যমে তৈরী হয়েছে। যা হিফজুল কোরআন ছাত্রদের জন্যে খুবই উপকারী।
হিফয বিভাগের রুটিন বিস্তারিত
১। প্রতিদিন ফজরের নামাজের দেড়ঘন্টা পূর্বে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে বসা এবং ফজর নামাজের পূর্বেই উস্তাদের কাছে নতুন সবক শুনানো।
২। ফজর নামাজের পর থেকে সকালের ব্যক্তিগত নাস্তা পূর্ব পর্যন্ত সাতসবক শুনানো।
৩।ফজর নামাজের দেড়ঘন্টা পর সকালের ব্যক্তিগত নাস্তার বিরতি—পনেরো মিনিট।
৪। নাস্তার পর থেকে সকাল ৮ঃ৩০ মিঃ পর্যন্ত আমুখতা ইয়াদ করা।
৫। সকাল ৮:৩১ মিনিট থেকে ৮ঃ৫৫ মিঃ পর্যন্ত মশক/তাজবীদ/তা’লীম।
৬। অতঃপর ৯ঃ৩০ মিনিট পর্যন্ত সকালের খাবার বিরতি ও ঘুমের প্রস্তুতি।
৭। সকাল ৯ঃ৩১ মিনিট থেকে ১১ঃ৩০ মিনিট পর্যন্ত দিনের ঘুম বিশ্রাম।
৮। সকাল ১১ঃ৩১ মিনিট হতে ১২ঃ০০ পর্যন্ত গোসল ও ক্লাসের প্রস্তুতি।
৯। অতঃপর ক্লাসে বসা এবং আমুক্তা শুনানো।
১০। দুপুর ১:২০ মিনিট থেকে ২:৩০ মিনিট পর্যন্ত যোহরের নামাজ, সম্মিলিত মোনাজাত/ দুপুরের খাবারের বিরতি।
১১। বিকাল ২:৩১ মিনিট থেকে ৩:৩০ মিনিট পর্যন্ত আমুক্তা শুনানো।
১২। আমুক্তা শুনানো শেষ হলে যার যার তিলাওয়াত করবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াত শেষে সবকের ছাত্ররা নাজেরা দেখবে আসর নামাজের পূর্ব পর্যন্ত।
১৩। বাদ আসর হতে মাগরীব পূর্ব পর্যন্ত ক্লাস বিরতি (খেলাধুলা,শরীরচর্চা,প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেয়া)।
১৪। বাদ মাগরীব হতে এশার নামাজের পূর্ব পর্যন্ত নতুন সবক মুখস্থ করা।
১৫। এশার নামাজের পরবর্তী ৩০ মিনিট রাতের খাবারের ছুটি।
১৬। রাতের খাবারের পর থেকে রাত ১০:০০ মিনিট পর্যন্ত সাতসবক ইয়াদ করা।
১৭। রাত ১০:০১ মিনিট হতে ১০ঃ২০ মিনিট পর্যন্ত সাতসবক /আমুক্তা দিয়ে নফল সালাত আদায় করা।
১৮। রাত ১০ঃ ২১ মিনিট হতে ফজর নামাজের দেড়ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত রাতের ঘুম।
হিফজ শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশনাঃ
• ভোর রাতে উঠে সম্ভব হলে দু-চার রাকাত তাহাজ্জুদ সালাত পড়ে নিবে ও আল্লাহর কাছে ইলম আমলের উন্নতির জন্য মুনাজাত করবে।
• প্রত্যেক নামাজের দশমিনিট পূর্বে নামাজের স্হানে উপস্থিত হয়ে সুন্নাত নামাজে আট-দশ পৃষ্ঠা তিলাওয়াত করিবে। এবং মাগরীবের পূর্বে দোয়ায় মাশগুল থাকিবে।
• ফরজ নামাজের পর আমলী সূরাগুলো তিলাওয়াত করিবে। এবং শুক্রবারে সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করিবে।
• ছবকের পরিমাণ নিম্নে ১ পৃষ্ঠা এবং উর্ধ্বে ৩ পৃষ্ঠা হবে।
• সিনিয়র কাউকে নাযেরা শুনিয়ে নেবে দিনের বেলা।
•দৈনিক তিলাওয়াত নূন্যতম ৫ পারা করবে।
•খতমীদেরকে প্রতিদিন নূন্যতম ১পারা করে শুনাতে হবে। বোর্ড পরীক্ষার আগে প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচপাড়া শুনানোর চেষ্টা করবে।
•সাতসবক বলতে সাতদিনের সবক। যারা একপৃষ্ঠা করে সবক দেয় তারা আধাপারা সাতসবক শোনাবে।আর যারা এক পৃষ্ঠার অধিক সবক দেয় তাঁরা সাতদিনে যত পৃষ্ঠা হয় সে পরিমাণ শোনাবে।
• সাতসবক ইয়াদ করার পর রাতের বেলা পরস্পর শুনিয়ে নেবে।
•ছবকের পারা একদিনের ভিতরেই বিনা লোকমায় শুনিয়ে শেষ করতে হবে। এবং দুই রাকাত নামাজে পড়তে হবে।
•রোজ বৃহস্পতিবার সাতসবক শোনানোর পর থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত শবিনা পড়িবে নূন্যতম ৮ পারা করে। এবং জুমার পূর্বাপর মিলিয়ে শবিনায় পঠিত পারাগুলো থেকে উস্তাদ প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পরীক্ষা নিবেন।
• দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শবিনা শোনাবে।
• আসরের পর হাতের লেখা সুন্দর করার জন্যে কিছু সময় ব্যয় করিবে।
•প্রতিদিন তথ্যবইতে সঠিক তথ্য লিখে সন্ধ্যার আগে জমা দিবে।
•প্রত্যেক খাবার ছুটিতে নির্ধারিত ক্বারীর তিলাওয়াত সাউন্ডবক্সে চলতে থাকিবে। এতে সহজেই তিলাওয়াতের সুর সুন্দর করা যাবে।
•প্রয়োজন হলে মাসে একদিন ছুটি কাটাবে।
• মাদ্রাসার সকল শিক্ষক ও ষ্টাফদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করিবে।
•সর্বাবস্থায় সুন্নাতের পাবন্দী করিবে।তাকওয়ার সাথে চলাফেরা করিবে।পড়াশোনা ও মনযোগে ব্যাঘাত ঘটায় এমন কাজ থেকে দূরে থাকিবে।অযু ইস্তিঞ্জায় অনর্থক সময় ব্যয় করিবে না।
• সুস্বাস্থ্যের প্রতি সর্ব্দা যত্ন নিবে। ভিটামিন যুক্ত খাবার খাবে। শরীর চর্চা করবে। সর্বাবস্থায় পরিচ্ছন্ন থাকিবে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকিবে। সকল বদভ্যাস পরিহার করে গোনাহমুক্ত জীবন গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করিবে।শুধুমাত্র পরকালীন সফলতার উদ্দেশ্যেই কোরআন হিফজ করিবে।
কুরআন হিফজ করার করার ফজিলত:
১। প্রতিদান দিবসে কুরআনের হাফেজকে তাঁর পঠিত প্রতিটি আয়াতের সংখ্যানুযায়ী একটি করে অট্টালিকা দান করা হবে।
২। কুরআনের হাফেজগণের হাশর-নশর হবে সম্মানিত ফেরেশতাগণের সাথে।
৩. কিয়ামাতের দিন হাফেজদের জন্য কুরআন সুপারিশকারী হবে।
৪. জাহান্নাম ওয়াজিব হয়েছে এমন দশজন আপনজনকে হাফেযে কোরআন সুপারিশ করে জান্নাতে নেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে।
৫. কুরআনের কল্যাণে হাফেজদের মা বাবা ও পরিবারের মর্যাদা বুলন্দ হয়।
৬. হাফেজে কোরআনের পিতামাতাকে কেয়ামত দিবসে নুরের মুকুট পরানাে হবে।
৭. হাফেজে কুরআনকে জাহান্নামের আগুন প্রজ্বলিত করবে না।
৮. কুরআন শিক্ষাকারী উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
৯. কুরআন আল্লাহর কালাম। যারা আল্লাহর কালাম হিফজ করে তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে যায়।
১০. হাফেজে কুরআনের জান্নাতে এমন উচ্চমর্যাদা হাসিল হবে, যা অন্যদের হবে না।
১১. কিয়ামত দিবসে হাফেজদেরকে ওয়াকার (সম্মানের) পােশাক পরিধান করানাে হবে, যার দিকে গােটা হাশরবাসী তাকিয়ে থাকবে।
১২। কুরআনের বরকতে হাফেজে কুরআনের অন্তর সর্বদা আলােকিত থাকে।
প্রিয় পাঠক, আশা করি হিফজ বিভাগের রুটিন সম্পর্কে ভালো ধারণা পেয়েছেন।
—হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম মিসবাহ