সম্মানিত দ্বীনপ্রিয় পাঠক, আজকের এই আর্টিকেল থেকে আপনি জানতে পারবেন ‘ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের জীবনী’।
أبو عبد الله أحمد بن محمد بن حنبل الشيباني
শ্রদ্বেয় ইমাম, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত, সুন্নাতের
পুনর্জীবিতকারী, বিদয়াত নির্মূলকারী মুহাদ্দিসগণের ইমাম, যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, বিশিষ্ট ফকীহ ও হাদিস বিশারদ, হাম্বলী মাযহাবের প্রবর্তক ‘আবু আবদুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন হাম্বল আশ-শাইবানি রহ:-কে আল্লাহ তার কবরকে আলোকিত, তাঁর শয্যাকে সুশীতল ও সুখময় করুন ।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের জীবনী:
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের জন্ম: ১৬৪ হিজরি।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল-এর মৃত্যু: ২৪১ হিজরি
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল-এর জীবনকাল: ৭৭ বছর।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
তাঁর নাম আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হাম্বল। উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। তিনি খাটি আরব বংশোদ্ভূত “শাইবান’ গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বিধায় তাঁকে ‘শাইবানি’ বলা হয়। ছিদ্দিকে আকবর বার্ষিক খেলাফত আমলের বিখ্যাত সেনাপতি মুছান্না ইবনে হারিছাও শাইবানি ছিলেন। ইমাম আহমদ রহ:-এর সম্মানিতা জননী মার্ভ থেকে বাগদাদ আসেন। ইমাম সাহেব তখন মাতৃগের্ভে ছিলেন।
রবিউল আউওয়াল ১৬৪ হিজরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন।
ইলম হাসিল
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. সর্বপ্রথম বাগদাদের উলামা-মাশাইখের থেকে ইলম হাসিল করেন। এরপর তিনি কুফা, বসরা, শাম, ইয়ামান প্রভৃতি শহর সফর করেন। প্রত্যেক স্থানের বিখ্যাত আলেম-মুহাদ্দিসদের নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ইমাম আহমদ রহ. বলতেন: সর্বপ্রথম আমার হাদিছের ইলম ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ এর খেদমতে থেকে হাসিল হয়। ইবরাহিম হারবি বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-কে জিজ্ঞাসা
করলাম—এসব সূক্ষ্ম মাসয়ালা আপনি কোত্থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন? তিনি বললেন, ইমাম মুহাম্মাদ রহ এর কিতাবাদি থেকে শিখেছি। হাফেয ইবনে সাইয়্যিদুন নাস ‘শরহুস সিরাহ’ গ্রন্থে লিখেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ শুরুতে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর নিকট ফিকহ ও হাদিছের ইলম হাসিল করেছেন। তিন বছর পর্যন্ত তাঁর খেদমতে কাটিয়েছেন। তাঁর থেকে তিন আলমারি পরিমাণ কিতাবাদি লিখেছেন।
১৮৭ হিজরিতে প্রথম হিজায সফরে ইমাম শাফি রহ-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এরপর বাগদাদে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়। ইমাম শাফিঈ রহ: বাগদাদ থাকাবস্থায় ইমাম আহমদ রহ. তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। তিনি ইমাম শাফিয়ি র.-এর ভীষণ ভক্ত ছিলেন। বলতেন, আমার নয়ন ইমাম শাফঈ রহ-এর মতো আর কাউকে দেখে নি। ইমাম শাফি রহ.-ও তাঁর খুব প্রশংসা করতেন।
ইমাম আহমদ রহ.-এর পরীক্ষা ও খলকে কুরআনের মাসয়ালা:
ঘটনাটি তারিখে বাগদাদ, মানাকিবে জাওযি, তবাকাতুশ শাফিয়া ইত্যাদি গ্রন্থে সবিস্তারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঘটনার সারকথা হল- সর্বপ্রথম কুরআন মাজিদকে খলক (সৃষ্ট) বলেছিল জা’দ ইবনে দিরহাম । সে
উমাইয়া যুগের লোক ছিল। তাকে খালিদ ইবনে আব্দুল্লাহ হত্যা করে ফেলে। তারপর জাহম ইবনে সফওয়ানও আল্লাহর গুণাবলিকে অস্বীকার করত। আল্লাহর সিফাতে কালামও সে অস্বীকার করত।
এরপর মুতাযিলাদের যুগ শুরু হয়। তারাও আল্লাহ তা’আলার গুণাবলিকে অস্বীকার করে। আর কুরআন মাজিদের আয়াত وكلم الله موسى تكليما (নিসা ১৬৪) এর ব্যাখ্যা করে আল্লাহ তায়ালা যেমনিভাবে অন্যান্য
মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, তেমনি কালামকেও সৃষ্টি করেছেন। মুতাযিলাদের উত্থান খলিফা হারুনুর রশিদের যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু তিনি এতে প্রভাবিত হন নি। কিন্তু তার পরে খলিফা মামুন তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
খলিফা মামুন সমস্ত আলেম-মুহাদ্দিসদের উপর নিজের প্রতিনিধি ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের মাধ্যমে নজরদারি লাগান। তিনি ২১৮ হিজরি সালে বাগদাদের গভর্নর ইসহাক ইবনে ইবরাহিমের নামে বিস্তারিত ফরমান পাঠালেন। তাতে ‘খলকে কুরআনের আকিদাকে কুরআন মাজিদের মর্যাদা পরিপন্থি’ জ্ঞানকারীদের কঠোর নিন্দা ও জঘন্য সমালোচনা করেন। তাঁদেরকে উম্মতের নিকৃষ্ট লোক বলে আখ্যা দেন। সমস্ত রাজ্য
প্রদেশেও উক্ত ফরমানের অনুলিপি পাঠিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয় ফরমান পালনে গভর্নর ইসহাক সমস্ত আলেমকে সমবেত করেন। ইমাম আহমদ রহ. ছিলেন তাঁদের অনুসৃত নেতা ও দিশারী। এরপর সমবেত সকল
আলেমকে প্রশ্ন করে তার জবাব শোনা হয়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ-কে প্রশ্ন করা হয়। কুরআন মাজিদ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
—ইমাম সাহেব: কুরআন মাজিদ আল্লাহর কালাম।
—ইসহাক: কুরআন কি মাখলুক?
—ইমাম সাহেব: কুরআন আল্লাহর কালাম। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে প্রস্তুত নই
—ইসহাক: আল্লাহর সমতুল্য তো কোনো কিছু হতে পারে না?
—ইমাম সাহেব: আমি জানি ليس كمثله شيء وهو السميع البصير (সূরা শূরা, আয়াত ১১)।
—ইসহাক: আল্লাহ তায়ালা এ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা হওয়ার মর্ম কী?
—ইমাম সাহেব: তিনি নিজের সিফাত-গুণ যেরূপ বর্ণনা করেছেন, তেমনই।
—ইসহাক: এর অর্থ কী?
—ইমাম সাহেব : আমি জানি না। তিনি নিজের সিফাত যেমন বলেছেন, তেমনই।
ইসহাকঅন্যান্য আলেমদের জবাবের সাথে ইমাম আহমদ রহ.-এর জবাবও লিখে পাঠিয়ে দেন। মামুন তা পড়ে চরম ক্ষুব্ধ-উত্তেজিত হয়ে উঠে। সে তাঁদের মধ্য হতে দুজন আলেমকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ জারি করলো। আর লিখলো বাকিদের মধ্যে যারা নিজের মতের উপর অনড় থাকবে, তাঁদেরকে আমার নিকট
পাঠিয়ে দিবে। কথা একদম পরিষ্কার। কালাম বস্তুত মুতাকাল্লিমের সিফত। মুতাকাল্লিম কাদিম হলে কালামও নিশ্চয় কাদিম হবে। অর্থাৎ, “কথা” কথকের গুণ। কথক প্রাচীন হলে তার কথাও প্রাচীন। এর বিপরীত সমস্ত মত ভ্রান্ত। আর আলেমগণ কেন ভ্রান্ত মতবাদ সমর্থন করবেন। তাই তাঁরাও সমর্থন করলেন না। সুতরাং সেসব আলেমকে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়ে খলিফা মামুনের দরবারে পাঠানো হল। আলেমগণ যখন ‘রাক্কা’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন খলিফা মামুনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া গেল। মৃত্যুর পূর্বে মামুন তার উত্তরসূরি মুতাছিমকে অছিয়ত করে গেল- কুরআনের ব্যাপারে তিনি যেন তার মতাদর্শ ও আকিদার উপর অটল থাকে। কাজেই সে তার পূর্বসূরির অসিয়তের উপর পূর্ণ আমল করলো। অসংখ্য উলামা-মাশাইখ জুলুম-নির্যাতন ও বিপদাপদের যাতাকলে পিষ্ট হলেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-কে মুতাছিম বিল্লাহর সামনে আনা হলে খলিফা মুতাছিম ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ:-কে নির্জনে ডেকে খুব বুঝালেন। ইমাম সাহেব বললেন, এদিক-ওদিকের কথা ছাড়ুন কুরআন-হাদিছের কথা বলুন!
এতে মুতাছিম ক্রুব্ধ হয়ে গেলো। পূর্ণ শক্তি দিয়ে চাবুক মারার নির্দেশ দিলো। তাঁকে আঠাশটি চাবুক মারা হল। একজন শক্তিশালী জল্লাদ মাত্র দুটি চাবুক মারত। এরপর ডাকা হত আরেক জল্লাদ। মুতাছিম প্রতিবারই বলতেন, খুব জোরে জোরে চাবুক মার! ইমাম
আহমদ রহ. প্রতিটি চাবুঘাতের সময় বলতেন :
أعطون شيئا من كتاب الله عز وجل أو سنة رسوله عليه الصلاة والسلام أقول به (حلية الأولياء وطبقات الأصفياء : ١٩٩/٩)
অর্থাৎ, আমার সামনে আল্লাহর কিতাব কুরআন কিংবা রাসূলুল্লাহ -এর হাদিসের কোনো দলিল নিয়ে এসো! তাহলে আমি মেনে নিব। [হিলইয়াতুল আউলিয়া : ৯/১৯৯]
তথাপি তিনি বারবার বলতেন, আল্লাহ! আমি মুতাছিমকে ক্ষমা করে নিয়েছি। এক সময় কেউ তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে তিনি বললেন “কিয়ামত দিবসে রাসূলুল্লাহ আর-এর কোনো স্বজনের আঁচল
আমার হাতে থাকবে এটা আমার খুব লজ্জা লাগে। বস্তুত মু‘তাছিম ছিল রাসূলুল্লাহ -এর সম্মানিত চাচা হযরত আব্বাস রাযি.-এর বংশধর। কিন্তু তার আকিদা-বিশ্বাস ভ্রান্ত ছিল। এটা প্রকাশ করা জরুরি ছিল। কেননা দ্বীনের বিষয়ে কারো ক্ষেত্রে ছাড় নেই। তার আকিদা-বিশ্বাসের ভ্রান্তি তুলে ধরাও ছিল রাসূলুল্লাহ এর ভালবাসায়। আর তার অপরাধ ক্ষমাও করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি এর প্রতি ভক্তি ভালবাসায়।
মোটকথা
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.-এর উপমাহীন দৃঢ়তায় এ মাসআলা চিরতরে শেষ হয়ে গেল। মুসলিম উম্মাহ রক্ষা পেল মারত্মক ভয়াবহ বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা থেকে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:-এর শাইখ ও শিষ্য: আল্লামা ইবনে জাওয়ি রহ. তার শাইখের সংখ্যা শতাধিক বর্ণনা করেছেন। কাজি আবু ইউসুফ, ওকি ইবনুল জাররাহ, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ কাত্তান, সুফিয়ান ইবনে উইয়াইনা, ইমাম শাফি রহ: প্রমুখ তন্মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ইমাম শাফিয়ি রহ. ব্যতীত বাকি সবাই ইমাম আবু হানিফা রহ-এর শিষ্য। আর ইমাম শাফিয়ি রহ. তাঁর শিষ্যের শিষ্য। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি রহ: ‘তাহযিবুত তাহযিব’ গ্রন্থে ইমাম আহমদ রহ.-এর শাইখ ও শিষ্যের সংখ্যা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। আর আল্লামা যাহাবি বহ, ছাত্র-শিষ্যের মধ্যে ইমাম বুখারি রহ., ইমাম মুসলিম রহ., আবু দাউদ রহ, আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ রহ. প্রমুখের নাম লিখে وخلق عظيم (আরো বিপুল সংখ্যক মানুষ) শব্দ লিখেছেন। এতে বুঝা যায়, ছাত্র-শিষ্যের সংখ্যা অগণিত। এর মধ্যে বড় বড় শাস্ত্রবিদ বা ইমামও আছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:-এর ইন্তিকাল: ইমাম সাহেব বয়স পেয়েছিলেন ৭৭ বছর। মৃত্যুর পূর্বে ১৯ দিন অসুস্থতায় ভোগেন। প্রস্রাবের সাথে রক্ত আসত। ডাক্তার দেখে বললেন, চিন্তা-পেরেশানি তার কলিজাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার
শরীর বেশি খারপ হয়ে যায়। শিষ্যগণ তাঁকে অজু করালেন। তখন খুব কষ্টে আঙুলি খিলাল করাতে বললেন। জুমার রাতে অবস্থা আরো খারাপ হয়। অবশেষে ১২ রবিঃ আউয়াল ২৪১ হিজরি সনে এ সুন্নাতের
পুনর্জীবিতকারী, বিদয়াত নির্মূলকারী এবং মুহাদ্দিসগণের ইমাম নশ্বর ভুবন ছেড়ে চিরস্থায়ী জগতে মহান মালিকের সান্নিধ্যে চলে গেলেন। আল্লাহ তার কবরকে আলোকিত, তার শয্যাকে সুশীতল ও সুখময় করুন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ এর কবর বাগদাদ, ইরাক।
রচনাবলি
কিতাবুস সালাত, কিতাবুযু যুহদ, কিতাবুন নাসিখি ওয়াল মানুসূখি ইত্যাদি তাঁর রচিত গ্রন্থ। তবে তাঁর রচনাবলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইলমি অবদান, মুহাদ্দিসসুলভ কীর্তি, সুপ্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় কিতাব তাঁর
মুসনাদ—মুসনাদে ইমাম আহমদ। হাফেয শামসুদ্দিন জাযরি রহ. বলেন: ইমাম আহমদ রহ. মুসনাদ কিতাবটি বিভিন্ন কাগজে লিখেছেন। বিভিন্ন খাতাপত্রে বিক্ষিপ্ত করে রেখেছিলেন। যেমনটি হয়ে থাকে পাণ্ডুলিপি। তা পরিমার্জন সম্পাদনার পূর্বেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। কিতাবটি সে অবস্থায় থেকে যায়।