রমজান ইসলামের একটি পবিত্র মাস। হিজরি ক্যালেন্ডারের নবম মাস হিসাবে পরিচিত। এ মাসেই মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছে। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ মাসেই জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। এ মাস— রহমতের মাস।মাগফিরাতের মাস। নাজাতের মাস। পবিত্র রমজান মাসের রোজা একটি ফরজ ইবাদাত। রমজান মাস হচ্ছে মুমিনদের ইবাদাতের সিজন। এই মাসের ইবাদাতের মাধ্যমেই জীবনের গতি পরিবর্তন ও একটি পবিত্র জীবন সূচনা করার সুবর্ণ সুযোগ।
সেজন্যে রমজানের ফজিলত, রোজার ফজিলত কি তা জানা আবশ্যক, নতুবা ইবাদাতের স্পৃহা জাগবে না। তাই আজ রমজানের ফজিলত নিয়ে ও রমযানের বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করব। আজকের পোস্ট থেকে জানতে পারব ‘‘রমজানের ফজিলত, সহীহ হাদীসের আলোকে রোজার ফজিলত দলিলসহ’’।
রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত, রমজানের ফাজিলত সম্পর্কে হাদিস।
রমজান মাসের রোযার ফজিলত কি?
উত্তরঃ রমজান মাসের রোজা রাখার মাঝে বহু ফজিলত ও সওয়াব রয়েছে। নিম্নে রোজার ফজিলতসমূহ উল্লেখ করা হল।
০১। হযরত আবু হুরাইরা রাযি: হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সোয়াবের আশা নিয়ে রমজান মাসের রোজা পালন করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে (প্রমাণ: বুখারী শরীফ হাদিস নং ১৮৯৬)।
০২। হযরত সাহল বিন সাদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন বেহেশতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে। কেয়ামতের দিন সে দরজা দিয়ে রোজাদাররা বেহেশতে প্রবেশ করবে। রোজাদার ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। কেয়ামতের দিন ডেকে বলা হবে রোজাদাররা কোথায়? তখন তাঁরা উঠে দাঁড়াবে। তাঁরা ছাড়া আর একজন লোকও সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। তাঁদের প্রবেশের পর তা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে সে দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে না পারে। (প্রমাণ বুখারী শরীফ হাদিস নং ১৮৯৬)
০৩। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মহান আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রমজান মাসের সাওম (রোযা) ফরয করেছেন এবং আমি তোমাদের জন্য তারাবীর সালাতকে সুন্নাত করে দিয়েছি। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার উপর দৃঢ়বিশ্বাস রেখে সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে রোযা রাখবে এবং তারাবীর নামাজ আদায় করবে, সে স্বীয় গুনাহসমূহ থেকে সেদিনের মতো পবিত্র হয়ে যাবে, যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছিল অর্থাৎ নবজাতকের ন্যায় নিষ্পাপে পরিণত হয়ে যাবে (প্রমাণ : সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ২২১০)।
০৪। রোজা হলো (পাপাচার-অপকর্ম থেকে) রক্ষার ঢাল স্বরূপ (প্রমাণ: বুখারী-১৮৯৪)।
অপর বর্ণনায় এসেছে রোজা (হলো জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষার) ঢাল স্বরূপ (প্রমাণ : আহমাদ ১৫২৯৯)
০৫। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, আদম সন্তানের প্রতিটি ভাল কাজ নিজের জন্য হয়ে থাকে, (রোযার বিষয়টি ভিন্ন) রোযা শুধুমাত্র আমার জন্য, অতএব আমি নিজেই এর প্রতিদান দিবো (প্রমাণ: বুখারী ১৯০৪)
০৬। যে কেউ আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য) একদিন সাওম পালন করবে, এর উসিলায় আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের রাস্তা সমপরিমাণ দূরবর্তীস্থানে রাখবেন (বুখারী ২৮৪০, মুসলিম১১৫৩)
০৭। রোজা পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, একটি হলো ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময় (প্রমাণ: বুখারী-৭৪৯২)
৮। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সিয়াম (অপকর্ম থেকে বাঁচার) ঢাল স্বরূপ। সুতরাং রোজাবস্হায় অশ্লীলতা করবে না এবং অজ্ঞতামূলক কাজ করবে না। যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে চায় অথবা তাঁকে গালিগালাজ করে, তাহলে সে যেন দুইবার বলে আমি রোজাদার। সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের গন্ধ মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট মেশকের (কস্তুরীর) সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। সে আমার জন্য পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকে। রোজা আমার জন্যেই। সুতরাং রোজার পুরস্কার আমি নিজেই দান করব (সহিহ বুখারী হাদিস: ১৮৯৪)।
৯। আবু হুরাইরা রাযি: থেকে বর্ণিত:
আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: শয়ততান ও দুষ্ট জিনদেরকে রমজান মাসের প্রথম রাতেই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। দোযখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, একটি দরজাও খোলা রাখা হয় না। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের একটি দরজাও বন্ধ রাখা হয় না। রমযাম মাসে একজন ঘোষণাকারী ফেরেশতা ঘোষণা দিতে থাকেন: হে কল্যাণ কামনাকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আল্লাহ তায়লার পক্ষ হতে বহু লোককে এ মাসে দোযখ থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। রমজানের প্রতি রাতেই রাতেই এরূপ হতে থাকে (তিরমিজি ৬৮২
, সহীহ ইবনু মাজাহ ১৬৪২)।
১০। আবু হুরাইরাহ রাযি: থেকে বর্ণিত:
তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ঈমানের সাথে এবং সাওয়াব লাভের আশায় যে ব্যক্তি রমযান মাসের রোজা পালন করলো এবং রাতে জেগে রইলো (ইবাদাতে রাত কাটালো), তাঁর পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর ঈমানের সাথে এবং সাওয়াব লাভের আশায় যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের রাত জেগে থাকে, তাঁর পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় (তিরমিজি ৬৮৩, সহীহ ইবনু মাজাহ ১৩২৬, বুখারী, মুসলিম)।
১১। আবূ হুরাইরা রাযি: থেকে বর্ণিত:
তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: রমাযান মাসে রহমতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করা হয় (সহিহ মুসলিম ২৩৮৬)।
আশা করি রমজানের ফজিলত ও রোজার ফজিলত সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন।
পবিত্র রমজান মাসের রোজা একটি ফরজ ইবাদাত।রমজান মাস হচ্ছে মুমিনদের ইবাদাতের সিজন। এই মাসের ইবাদাতের মাধ্যমেই জীবনের গতি পরিবর্তন ও একটি পবিত্র জীবন সূচনা করার সুবর্ণ সুযোগ।সেজন্যে আমাদের ইবাদাতসমূহ বিশুদ্ধ হওয়া শর্ত। ইবাদাত তখনই বিশুদ্ধ হবে যখন ইবাদাত সম্পর্কে আমার পূর্ণ ধারণা থাকবে। আর আপনাকে পূর্ণ ধারণা দেবার প্রয়াস নিয়ে ‘আমার ইশতিহার ব্লগ’ রমজান মাসের জীবনঘনিষ্ঠ ইবাদাতসমূহ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্টিকেল সংকলন করেছে। এর মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন রমজান মাস সম্পর্কিত ইবাদাতের মাসয়ালা মাসায়িল। ধৈর্য সহকারে শেষপর্যন্ত পড়ে নিলে বিশুদ্ধ ইবাদাত করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
রোযা সম্পর্কিত পাঁচটি প্রশ্ন :
১নং প্রশ্ন: রোজা কাকে বলে?
রোজার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। পরিভাষায় রোজা বলা হয়: সুবহে সাদিক (ফজরের ওয়াক্তের পূর্ব) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,কামাচার (সহবাস), পাপাচার এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা। রোজার আরবি হচ্ছে সিয়াম, অনেকেই জানেন না সিয়াম অর্থ কি? সিয়াম অর্থ হল ‘উপবাস’ থাকা ।
২নং প্রশ্নঃ রমজানের রোজার বিধান কি?
উত্তরঃ ইসলামী শরীয়তের বিধানানুযায়ী রোজার হুকুম হচ্ছে ‘ফরজ, যা পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর উপর অত্যাবশকীয়। রোজা বা সিয়াম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। রোজা অস্বীকার করলে অস্বীকারকারী কাফের হয়ে যাবে।
৩নং প্রশ্ন: রোজা কি কোরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত?
উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে রোজার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে-
يأيها الذين أمنو كتب عليكم الصيام كما كتب علي الذين من قبلكم لعلكم تتقون
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম (রোযা) ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের উপর ফরয করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণাবলী সৃষ্টি হয়ে যাবে।
হাদীসের আলোকে রোজার বিধানঃ
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সোয়াবের আশা নিয়ে রমজান মাসের রোজা পালন করবে তার অতীত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (প্রমাণ:বুখারী শরীফ হাদিস নং ১৮৯৬)
৪নং প্রশ্নঃ রমজানের রোজা কি শুধুমাত্র মুহাম্মদ সা. এর উম্মতের উপর ফরজ করা হয়েছে?
উত্তর: না, পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের উপরও ফরয ছিল (প্রমাণ: সূরা আল বাকারা, আয়াত নং ১৮৩)।
প্রাসঙ্গিক আলোচনা: এই আয়াতের মধ্যাংশ দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উম্মতে মুহাম্মদীদের মনের ভয় দূর করার জন্যে বাস্তব একটি উদাহরণ দিয়ে সাহস দিচ্ছেন যে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা ভয় পেয়ে যেয়ো না। একমাস রোযা রাখা তোমাদের জন্যে অবশ্যই সম্ভব। কারণ তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণও রোজা রেখেছে। তাঁরা পেরেছে তোমরাও পারবে। কারণ আল্লাহ মানুষের সাধ্যের বাইরে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেন না।
৫নং প্রশ্ন: রমজানের রোজার উদ্দেশ্য কি?
উত্তর: যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক রমজান মাস আমাদেরকে দিয়েছেন, সেই উদ্দেশ্য যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলেই রমযানের পূর্ণ খায়ের ও বরকত আমরা হাছেল করতে পারব।
শরীয়তের প্রত্যেকটা আমলের একটা সহীহ উদ্দেশ্য বা সহীহ মাকসাদ থাকে। প্রত্যেকটা আমলের সেই সহীহ মাকসাদ যদি অর্জন করা যায়,তাহলে সেই আমলের দ্বারা পুরােপুরি উপকৃত হওয়া যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদেরকে যে রােযার বিধান দেয়া হয়েছে, এই রােযার উদ্দেশ্য কি তা আল্লাহ রাব্দুল আলামীন নিজেই বলে দিয়েছেন। সূরা বাকারা : ১৮৩ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মু’মিনরা! তােমাদেরকে রােযার বিধান দেয়া হল, যেমন তােমাদের পূর্ববর্তীদেরকেও রােযার বিধান দেয়া হয়েছিল। এই রােযার বিধান দেয়া হল এই উদ্দেশ্যে, যাতে তােমরা তাকওয়া-পরহেযগারীর অধিকারী হতে পার।
তাকওয়া অর্থ: তাকওয়া বা পরহেযগারী-এর অর্থ হল বিরত থাকা, সংযমী হওয়া। অর্থাৎ গােনাহ থেকে বিরত থাকা, পাপের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া। বুঝা গেল রােযার উদ্দেশ্য হল গােনাহ থেকে বিরত থাকা, পাপের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া।
প্রিয় পাঠক, ধারাবাহিকভাবে আমরা রমজানের ফজিলত, রোজার ফজিলত, রোযার নিয়ত, ইফতারের গুরুত্ব, ইফতারের দোয়া, সাহরির গুরুত্ব, সাহরির নিয়ত, ইতেকাফের গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে লেখা আপলোড করব। আশা করি আপনারা উপকৃত হবেন।