আমার ইশতিহার
সুপ্রিয় পাঠক! নিশ্চয়ই আপনার মনের ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে লেখক হওয়ার একটা শখ ও সোনালি স্বপ্ন লালন করে আসছেন; কিন্তু সেই সোনালি স্বপ্ন পূরণের জন্যে সঠিক কোনো গাইডলাইন পাচ্ছেন না। তাই হতাশায় আপনার লেখক হওয়ার স্বপ্ন নিষ্প্রভ হয়ে । যদি সত্যি আপনার এই বেদনপূর্ণ অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে আপনার জন্যেই আমরা রচনা করেছি “ ভালো লেখক হবার ১০টি উপকারী টিপস”। ধৈর্য্যসহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ুন ইনশাআল্লাহ আপনার সেই মরণাপন্ন স্বপ্ন আবার চোখ তোলে তাকাবে, সাহিত্যের আকাশে ডানা মেলে উড়বে।
লেখালেখির প্রয়োজনীয়তা:
হৃদয়বৃত্তি প্রকাশের অন্যতম উপায় হলাে লেখালেখি। মানুষের মনে কত কিছু আসে, কত ভাব ও ভাবনা উদিত হয়; কত স্বপ্ন-কল্পনা আনাগােনা করে, সব তাে বলা আর যায় না, বলার মত পরিবেশও পাওয়া যায় না। কিন্তু লিখে রাখা যায়, কলমবন্দ করা যায় যে কোনাে মুহূর্তে। কলম বিশ্বস্ত সেবকের মত ধরে রাখে আমাদের মনােবৃত্তি ; ভাব ও ভাবনা, স্বপ্ন-কল্পনা। স্মৃতি বিস্মৃত হয়, বিশ্বাস হারায়, কিন্তু কলম মানুষের বিশ্বস্ত সেবক যুগ যুগান্তরের।
বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার কীভাবে এসেছে আমার কাছে? সামান্য এই কলমের মাধ্যমে। পূর্বসুরীদের রেখে যাওয়া দুর্লভ অভিজ্ঞতা কীভাবে পৌছেছে আমার হাতে? ছােট্ট এই কলমের সাহায্যে। এই যে সমৃদ্ধ পাঠাগার, জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা, নানা উদ্ভাবন আবিষ্কার, শত শত শাস্ত্র, বাদ-মতবাদ এসব কীভাবে সংরক্ষিত হয়েছে? দুর্বল এই কলমের সাহায্যে। কলম দুর্বল কিন্তু অতি বিশ্বস্ত। বিশ্বস্ত সেবকের মত। কলম সংরক্ষণ করেছে তাদের অমূল্য জ্ঞান, দুর্লভ অভিজ্ঞান। তাদের রেখে যাওয়া বিপুল জ্ঞানসম্পদ। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে তাঁদের। বহু ত্যাগের ফল, সাধনার ফসল। বহু বিনিদ্র রজনীর একনিষ্ঠ সাধনার অমূল্য উপহার। যক্ষের ধনের ন্যায় কলম আগলে রেখেছে তাদের ক্ষুৎপিপাসার দান, সুদীর্ঘ ভ্রমণ পরিক্রমণের অবদান। কত সাধনা গবেষণা, যুগ যুগের পরিশ্রমের ফল এই জ্ঞান-ভাণ্ডার! কত পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিনিদ্র রজনীর সাধনার ফসল এই জ্ঞানসম্পদ! কত মনীষী এ পথে খরচ করেছেন বিপুল অর্থবিত্ত! জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করেছেন অকাতরে! জীবন যৌবন খুইয়েছেন জ্ঞানের সেবায়, জ্ঞানের সমৃদ্ধি সাধনায়। আমাদের জন্য রেখে গেছেন জ্ঞানের অমূল্য ভাণ্ডার। আমাদেরও উচিত জ্ঞানের সেবায়, জ্ঞানের সাধনায় আত্মনিয়ােগ করা। জ্ঞানের এ পবিত্র আমানত মেধা ও শ্রম দিয়ে, সাধনা ও পরিশ্রম দিয়ে সমৃদ্ধ করা এবং পূর্ববর্তীদের রেখে যাওয়া আমানত পরবর্তীদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া ।
যদি লেখক হতে চাও!
‘লিখতে হলে শিখতে হয়’ কথাটা সম্ভবত বলেছেন কবি নজরুল ইসলাম এবং অতি সত্য কথাই বলেছেন। শুধু লেখা কেন, পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যা উত্তমরূপে না শিখে সুচারুরূপে সম্পাদন করা যায়। হাওয়া ভর্তি বলে লাথি মেরে জগতজোড়া যারা খ্যাতি পেয়েছেন তাদেরও করতে হয়েছে সুকঠিন সাধনা এবং সুদীর্ঘ অনুশীলন। একজন কণ্ঠশিল্পীকে নামাজ পড়লেও শেষ রাতের সাধনায় তাকে আত্মনিয়ােগ করতে হয়। নিয়মিত রেয়াজ করতে হয়। সেখানে সাহিত্য তাে একটি সুকুমার বৃত্তি। তাই পূর্ণ আত্মনিবেদন ও একনিষ্ঠ সাধনা ছাড়া সাহিত্যের ভুবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর যে কোনাে ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে যারাই স্মরণীয় হয়েছেন এবং অমর কীর্তি ও কর্মের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, নিরলস সাধনার মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলাে কীভাবে লেখালেখি শেখা যায়? একজন সফল লেখক হওয়ার জন্য আমাদের কী করণীয়? অনেক বই পত্র মন্থন করে আমি কয়েকটা সূত্র বের করেছি ।
০১। আদর্শ লেখক হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলাে হৃদয়ের গভীরে লেখার প্রতি প্রেম ও মমতা লালন করা। এটা তােমাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করবে । এবং সাধনায় প্রলুব্ধ করবে। হৃদয়ের সহজাত প্রেরণাই তােমাকে সাধনার পথে ব্যাকুল করে তুলবে এবং পৌছে দিবে উৎকর্ষের শীর্ষ শিখরে। তাই লেখার প্রতি গভীর ভালােবাসা লালন করাে। জেনে রাখাে , নিরুত্তাপ হৃদয়ে আর যাই হােক সাহিত্য চর্চা হয় না ।
০২। আদর্শ লেখক হওয়ার জন্য তােমাকে পড়তে হবে প্রচুর। আদর্শ লেখকদের মানােত্তীর্ণ লেখাগুলাে গভীর মনােযােগের সঙ্গে বারবার পড়বে এবং লেখার রূপ রস গন্ধ স্বাদ আত্মস্থ করবে । তারা কীভাবে লেখেছেন, কেমন শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠন করেছেন, কী ধরনের রীতি ও শৈলী ব্যবহার করেছেন? কীভাবে বিষয়বস্তুর বিস্তার ও সংকোচন করেছেন? কীভাবে বক্তব্য ও তার যুক্তি উপস্থাপন করেছেন? এগুলাে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করবে।
০৩। যে কোনাে বই-পত্র পড়ার সময় সুন্দর শব্দ, চমৎকার বাক্য, বিরল উপমা উৎপেক্ষা, আকর্ষণীয় চিত্রকল্প পেলে মুখস্থ ও আত্মস্থ করবে এবং নিজের লেখায় সেগুলাে প্রয়ােগ করবে। এভাবে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখকদের লেখা থেকে নিজের সঞ্চয় বাড়াবে এবং সেগুলাের সুপ্রয়ােগ ঘটাবে। মনে রাখবে, রচনার সৌন্দর্যবর্ধণে মুখস্থ বাক্য ও মুখস্থ বর্ণনাশৈলীর ভূমিকা বিরাট ।
০৪। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত বইগুলাে অভিনিবেশ সহকারে পড়বে এবং শব্দ ভণ্ডার সংগ্রহ করবে। শব্দের মােড়কে লুকিয়ে আছে কোন্ বাণী খুঁটে খুঁটে জানবে। অভিধান ঘেঁটে বের করবে দুর্বোধ্য শব্দের অর্থ। তারপর ব্যবহার কী, আর কোন্ কোন্ অর্থে আসে তাও জানবে। পরে নিজের মত করে ছােট ছােট বাক্যে সেগুলাে ব্যবহার করবে। তাহলে শব্দটা আর বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের থাকবে না , নিজের হয়ে যাবে ।
০৫। লেখক হতে হলে তােমাকে লিখতে হবে প্রচুর। নিরন্তর সাধনায় আত্মনিয়ােগ করতে হবে। কলম না ধরে সারাজীবন পড়েও তুমি লেখক হতে পারবে না। তবে প্রথমেই গুরুগম্ভীর চিন্তামূলক রচনা লেখা শুরু করে দিবে না। বরং সহজ শব্দে সহজ বাক্যে হালকা বিবরণমূলক লেখা লিখবে। সাধারণ নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা, মনের আনন্দ-বেদনা, ক্ষোভ-হতাশা, অনুভব – অনুভূতি ইত্যাদি প্রকাশ করবে অসংকোচে । ঠিক যেভাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর সাথে অন্তরঙ্গ পরিবেশে অন্ত রঙ্গ বিষয়ে আলাপ করাে।
০৬। নিয়মিত লিখবে। প্রতিদিন অল্প হলেও লিখবে। পরদিন সেটা নিয়ে বসবে। বারবার পড়ে দেখবে কোনাে অসঙ্গতি আছে কিনা। আরাে কিছু বাড়ানাে যায় কি না। সুন্দর শব্দ , চমৎকার বাক্য , হৃদয়গ্রাহী
উপমা উৎপ্রেক্ষা দিয়ে লেখাটা ঢেলে সাজাবে। এমন কোনাে লেখা নেই যাকে পরিমার্জন করে আরাে সুন্দর করা যায় না।
০৭। যে বিষয়ে লিখতে চাও তাতে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে ভাববে এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করবে। তােমার ভাবনা যত গভীর হবে, তথ্য উপাত্ত যত সমৃদ্ধ হবে, লেখাটি হবে তত সারগর্ভ, গতিশীল ও হৃদয়গ্রাহী । তােমার অভিজ্ঞতার সীমানার বাইরে কোন বিষয়ে কলম ধরার চেষ্টা করাে না।
০৮। মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন হৃদয় খুব নরম হয়, কোমল ও আদ্র হয় এবং ভিতরে ভাবের ও আবেগের তরঙ্গদোলা অনুভূত হয়। নিজের অজান্তেই তখন লেখার একটি স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণ জাগ্রত হয়। স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণার এ মুহূর্তটি কখনাে হাতছাড়া করবে না। তখনই কলম নিয়ে বসে যাবে এবং লেখায় নিমগ্ন হবে। ঐ মুহূর্তটি হলাে লেখার সুবর্ণ মুহূর্ত। তখন চিন্তা করে শব্দ ও বাক্য খুঁজে লিখতে হয় না, বরং ঝরণাধারার মত প্রবল বেগে লেখা আসতে থাকে।
০৯। কোনো বিষয়ে লেখা শেষ হলে তা পড়ে কানে বাজিয়ে শুনবে খসখসে অমসৃণ লাগে কিনা। যদি শুনতে রসপূর্ণ না হয় তাহলে যথেষ্ট সময় নিয়ে পূর্ণ যত্নের সাথে সংশােধন করবে। যতক্ষণ না তৃপ্ত হও, পরিবর্তন পরিবর্ধন ও পরিমার্জন চালিয়েই যাবে।
১০। সর্বশেষ মনে রাখবে সাহিত্যের উৎস হৃদয় , অন্যকিছু নয়। মন যত সুন্দর হবে, চিন্তা যত পরিচ্ছন্ন হবে এবং চরিত্র যত সুবাসিত হবে, লেখার জন্য মনের জমি তত উর্বর ও উপযােগী হবে। ভাষার সঙ্গে হৃদয়ের এবং কলমের সঙ্গে কলবের সংযােগ না হলে লেখা কখনাে সুন্দর হয় না। তাই চিন্তার সংকীর্ণতা বর্জন করাে এবং হৃদয়ের উদারতা অর্জন করাে। সকল নীচতা ও ক্ষুদ্রতা থেকে হৃদয়কে মুক্ত করাে এবং প্রেম-প্রীতি ও মহত্ত্ব দ্বারা হৃদয়কে সিক্ত করাে। কলমের সঙ্গে কলবের বন্ধন তৈরী করাে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হও এবং প্রকৃতির স্রষ্টাকে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত করাে। তা নাহলে তােমার সমস্ত সাহিত্য সাধনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেননা ভাব ছাড়া শুধু শব্দ দ্বারা সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। আর ভাব আসে প্রকৃতির মাধ্যমে,প্রকৃতির স্রষ্টার কাছ থেকে এবং ভাব শুধু স্বচ্ছ হৃদয়েই উদ্ভাসিত হয়।
এই ছিলো আমাদের লেখক হওয়ার দশ উপায়।
প্রথমে লেখক হবার এই উপায়গুলো ভালো করে বুঝে নেন ও আত্মস্থ করুন।