মুসলিম পণ্ডিত, ইসলামি আইনবিদ, ভাষাবিদ, বিশিষ্ট ফকীহ ও হাদীস বিশারদ, ইমাম আযম আবু হানিফার শিষ্য ও সঙ্গী, হানাফি মাযহাবের পৃষ্ঠপোষক, ইরাকের বিশিষ্ট মুফতি,
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে আশ-শায়বানী, আল কূফী,আল হানাফি রহ:।
الإمام محمد بن الحسن بن فرقد الشيباني، الكوفي الحنفي.
মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর কবরকে আলোকিত করুন এবং তাঁর শয্যাকে আরামদায়ক করুন।
ইমাম মুহাম্মাদের জীবনীঃ
ইমাম মুহাম্মদের জন্ম: ১৩২ হিজরি
ইমাম মুহাম্মদের মৃত্যু : ১৮৯ হিজরি।
ইমাম মুহাম্মদের জীবনকাল : ৫৭ বছর।
নাম ও বংশ পরিচয়:
তাঁর নাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান শাইবানি। উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। তিনি শাইবান গোত্রের মাওলা আজাদকৃত দাস ছিলেন বিধায় তাকে শাইবানি বলা হয়। বংশগত দিক থেকে তিনি শাইবান গোত্রের লোক ছিলেন না। তাঁর জন্ম ১৩২ হিজরি সনে; মৃত্যু ১৮৯ হিজরি সনে।
ইমাম মুহাম্মদের শিক্ষাদীক্ষা:
ইমাম মুহাম্মদ রহ. ইমাম আমু হানিফা রহঃ এর ছাত্র ছিলেন। ইমাম আযম আবু হানিফা রহ.-এর তিরোধানের সময় ইমাম মুহাম্মদ রহঃ-এর বয়স মাত্র আঠারো বছর ছিল। এজন্য তিনি বেশি দিন ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর নিকট শিক্ষা লাভ করতে পারেন নি। সেজন্য হানাফি ফিকহের পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছেন ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর নিকট।তাছাড়া ইমাম মুহাম্মদ রহ সিরিয়ায় ইমাম আওযায়ীর কাছে ও মদিনায় ইমাম মালেকের কাছে তিনবছর ইলমে হাদীস শিক্ষা করেন। ইমাম মুহাম্মদ রহঃ বলেন, আমার পিতা আমার জন্য ৩০ হাজার দিরহাম রেখে যান। আমি এর ১৫ হাজার আরবি ব্যাকরণ ও কবিতা শেখায় এবং অবশিষ্ট ১৫ হাজার হাদীস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জনে ব্যয় করি।
ইমাম আহমদ সম্পর্কে মনীষীদের অভিমত:
১। ইমাম শাফিয়ি রহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হাসান মানুষের হৃদয় ও দৃষ্টিকে প্রভাব দ্বারা ভরে দিতেন। তিনি আরো বলেন, ইমাম মুহাম্মদ ছিলেন বড় সুসাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বক্তৃতা করলে শ্রোতামণ্ডলী মনে করত, পবিত্র কুরআন তাঁর ভাষায়ই অবতীর্ণ হয়েছে। শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি সুহৃদ মানুষ ছিলেন। নিজের সম্মান-সম্ভ্র কখনো ভুলতেন না।
২। খতিবে বাগদাদি রহ: বর্ণনা করেন, একবার খলিফা হারুনুর রশিদ এলেন। তাঁর সম্মানে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে হাসান রহ. দাঁড়ালেন না। খাদেম এসে মুহাম্মাদ ইবনে হাসানকে ডেকে নিয়ে গেল। তাঁর সাথী এবং ছাত্ররা খুব ভয় পেল। খলিফার দরবার থেকে বাইরে এসে উপস্থিত হলে সবাই অবস্থা জিজ্ঞাসা করল। মুহাম্মাদ রহ. বললেন, খলিফা হারুন রশিদ প্রশ্ন করেছেন। আপনি লোকদের সাথে কেন দাঁড়ালেন না? আমি বললাম আপনি আমাকে যে শ্রেণিতে শামিল করেছেন, সে শ্রেণি থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমার নিকট পছন্দ হয়নি। আপনি আমাকে আলেম সমাজের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ আলেম সমাজ থেকে বেরিয়ে সেবক শ্রেণির সঙ্গে মিলে যাওয়া আমার কাছে পছন্দ হয় নি।
ইমাম মুহাম্মদের রচনাবলি:
ইমাম মুহাম্মদ রহ.-এর রচনাবলি তার শ্রেণিবিন্যাস: ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর রচনা সমগ্রকে হানাফি ফিকহের প্রথম উৎস জ্ঞান করা হয়। সেটা ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে বর্ণিত হোক চাই ইরাকিদের সাধারণ প্রচলিত ফিকহ থেকে সংকলিত হোক কিংবা ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর অন্যান্য উস্তাদদের থেকে সংগৃহীত। অবশ্য ভালোভাবে স্মরণে রাখতে হবে, ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বিরচিত সমস্ত কিতাব সনদ ও নির্ভরযোগ্যতার বিচারে সমান নয়। আলেমগণ তাঁর কিতাবগুলো নির্ভরযোগ্যতার বিচারে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা: প্রথম শ্রেণি: জাহিরু রিওয়ায়াহ কিতাবসমূহ এগুলো নিম্নোক্ত ৬টি কিতাব : (১) আলু মাবসূত। (২) আয যিয়াদাত। (৩) আল জামিউস সগির। (৪) আস সিয়ারুছ ছগির। (৫) আস্ সিয়ারুল কাবির। (৬) আল জামিউল কাবির। এগুলোকে বলা হয় ‘উসুল”। বাকিগুলোকে ‘জাহিরুর বিওয়ায়াহ’ বলার কারণ হল, এ কিতাবগুলো ইমাম মুহাম্মাদ রহ. থেকে নির্ভরযোগ্য রাবীদের সূত্রে বর্ণিত। অর্থাৎ মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত বা অন্তত এগুলো মশহুর পর্যায়ের। অবশ্য জাহিরুর রিওয়ায়াহ কিতাবসমূহ ছাড়াও তাঁর আরো চারটি কিতাব এ শ্রেণিভুক্ত। যেমন, কিতাবুল আছার। এতে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. সেসব আছার একত্র করেছেন, যেগুলো দ্বারা হানাফিগণ ইজতিহাদ করেন। এভাবে ‘কিতাবুর রদ্দি আলা আহলিল মাদিনাতি ও প্রথম শ্রেণিভুক্ত। ইমাম শাফেয়ী রহ তাঁর ‘কিতাবুল উম’-এর মধ্যে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. থেকে এ কিতাব বর্ণনা করে তার খণ্ডন করেছেন। সেই সঙ্গে মদিনাবাসীর বহু মতামতের সমর্থনও করেছেন।
দ্বিতীয় শ্রেণি : দ্বিতীয় শ্রেণি দ্বারা ইমাম মুহাম্মাদ রহ-এর সেসব কিতাব উদ্দেশ্য, যেগুলো তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির কিতাবাদির সমতুল্য নয়। যথা: (১) কায়সানিয়্যাত। (২) হারুনিয়্যাত। (৩) জুরজানিয়্যাত। (৪) আর রাক্কিয়্যাত। (৫) যিয়াদাতু যিয়াদাত। উপর্যুক্ত কিতাবগুলোকে বলা হয় ‘গাইরু জাহিরির রিওয়ায়াহ’। কেননা ইমাম মুহাম্মাদ রহ থেকে বর্ণিত হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো প্রথম শ্রেণির সমতুল্য নয়।
ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর অন্যান্য রচনাবলী:
এ ছাড়াও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর রচিত আরো অনেক গ্রন্থ আছে। আলেমগণ সাধারণত সেগুলো উল্লেখ করেন না। কিন্তু প্রসিদ্ধির ক্ষেত্রে সেগুলো কোনো অংশেই জাহিরুর রিওয়ায়াহ কিতাবসমূহ থেকে কম নয়। তাঁর সংকলিত কিতাবের মধ্যে মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ জগৎবিখ্যাত।
মোটকথা, ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ হানাফি ফকিহদের মাঝে প্রথম পর্যায়ের ফকিহ এবং ইমাম আবু ইউসুফের পর ইমাম আযম আবু হানিফা রহ: এর একজন যোগ্য শিষ্য। উনার মেহনতের বদৌলতে হানাফি মাজহাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইমাম মুহাম্মদের ইন্তিকাল:
এই মহামনস্বী ১৮৯ হিজরিতে ৫৭ বছর বয়সে রায় নুবিয়া নামক স্হানে ইহজগৎ ত্যাগ করেন।