ইমাম আবু হানিফার খাস শাগরেদ, হানাফি মাযহাবের মুখপাত্র, কাযিউল কুযাত, ফকিহ, মুজতাহিদ, মুহাদ্দিস—
أبو يوسف يعقوب بن إبراهيم بن حبيب بن حبيش بن سعد بن بجير بن معاوية الأنصاري الكوفي.
আবু ইউসুফ ইয়াকুব বিন ইব্রাহিম আল আনসারী আল কূফী রহ:। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর কবরকে আলোকিত করুন এবং তার শয্যাকে আরামদায়ক করুন।
ইমাম আবু ইউসুফ এর জীবনী
ইমাম আবু ইউসুফের জন্ম ১১৩ হিজরী
ইমাম আবু ইউসুফের মৃত্যু ১৮২ হিজরি
ইমাম আবু ইউসুফের জীবনকাল ৬৭ বছর।
ইমাম আবু ইউসুফের জন্ম ও বংশ পরিচয়:
ইমাম আবু ইউসুফ রহ এর বংশ পরম্পরা হল- ইয়াকুব ইবনে ইব্রাহিম ইবনে হাবিব ইবনে হুবাইশ ইবনে সাদি ইবনে জুবাইর আনসারি। তার নাম ইয়াকুব। উপনাম আবু ইউসুফ। তাঁর পিতার নাম ইব্রাহিম।ইমাম আবু ইউসুফের বংশপরম্পরা হযরত সা’দ আনসারি রাযি: এর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। তাঁর পিতা ছিলেন দীন-দরিদ্র-শ্রমজীবী মানুষ। মেহনত করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সাধারণত প্রসিদ্ধ হল, তিনি ১১৩ হিজরিতে কূফায় জন্মগ্রহণ করেছেন।
ইমাম আবু ইউসুফের ইলম হাসিল:
তাঁর মধ্যে ইলম হাসিলের প্রবল আগ্রহ ছিল; কিন্তু পিতার ইচ্ছে ছিল না। তিনি চাইতেন, ছেলে কোনো কাজ-কর্ম শিখুক। দু-চার পয়সা কামাই করে ঘরে আনুক। এতদসত্ত্বেও সময়-সুযোগে কাজি (ইমাম আবু ইউসুফ) সাহেব রহ. আলেমদের সংস্রবে চলে যেতেন। কাজি সাহেব নিজেই বর্ণনা করেছেন, আমি প্রথমে ইবনে আবু লাইলা রহ-এর খেদমতে যাতায়াত করতাম। তিনি আমাকে যথেষ্ট গুরুত্বও দিতেন। কিন্তু তিনি ইলমি কোনো প্রশ্ন জাগলে সেটা ইমাম আবু হানিফা রহ এর মাধ্যমে সমাধান করতেন। এজন্য আমার একান্ত মনোবাসনা ছিল, আমিও ইমাম সাহেবের খেদমতে গিয়ে শিক্ষা লাভ করব। কিন্তু ইবনে আবি লাইলা রহ-এর মনঃকষ্টের চিন্তা বাধা হয়ে দাঁড়াত। তবু শেষ পর্যন্ত আমি ইমাম আবু হানিফা রহ-এর খেদমতে হাজির হতে শুরু করলাম।
ইমাম আবু ইউসুফের বিখ্যাত ছাত্রবৃন্দ:
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ শাইবানী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. ইমাম আহমদ ইবনে আবি তাইবা আদ দারমি রহ:।
ইমাম আবু ইউসুফ রহ সম্পর্কে মনীষীদের উক্তি:
ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর প্রিয় শিষ্য আল্লামা মুযানি রহ. বলেন: আবু ইউসুফ রহ হাদিসের সর্বাধিক অনুসারী।
ইয়াহইয়া ইবনে মাইন রহ. বলেন, ‘আসহাবুর রায়ের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ রহ: হতে বড় কাসিরুল হাদিস ও সুবিজ্ঞ হাদিছ বিশারদ অপর কেউ নেই। ইবনে মাঈন থেকে আরো বর্ণিত আছে, ইমাম আবু ইউসুফ রহ. একজন সাহিবে হাদিস ও সাহিবে সুন্নাত ।
ইমাম আহমদ রহ. বলেন, ইমাম আবু ইউসুফ হাদিসের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ ছিলেন।
জাওয়াহিরে মুযিয়্যা গ্রন্থে লিখা আছে : ইমাম আহমদ রহ., ইবনে মাঈন রহ ও ইবনে মানিনি রহ বলেছেন- ইমাম আবু ইউসুফ রহ. একজন ছিকাহ্-নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান হযরত বেলাল ইবনে ইয়াহ্ইয়ার উক্তি বর্ণনা করেছেন- ইমাম আবু ইউসুফ রহ ছিলেন তাফসির, মাগাযি (যুদ্ধ-জিহাদ) ও আরব ইতিহাসের হাফেয। ইলমে ফিকহ ছিল তাঁর জন্য সাধারণ বিষয়।
বিচারপতির পদ গ্রহণ প্রসঙ্গ:
বাদশাহ হারুনুর রশীদ তাঁর খেলাফতকালে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-কে পুরো সাম্রাজ্যের বিচারক বানান। সাধারণ বিচারক নয় বরং কাযিউল কুযাত বা চিপ জাষ্টিস।
ইমাম আবু ইউসুফের উপর অভিযোগ:
বাকি রইল বাদশার সান্নিধ্য এবং বিচারপতির পদ গ্রহণের অভিযোগ। বস্তুত এটা অভিযোগই নয়। রাষ্ট্রপরিচালনা দোষের নয়। এতে সহায়তা করাও দোষের নয়। সাধারণ বিচারপতির বা প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণও অপরাধ নয়। পক্ষান্তরে অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা নিঃসন্দেহে অপরাধ। এতে সহায়তা করা অর্থাৎ, গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহায়তার শামিল এবং তা নাজায়েয।
সঠিকভাবে রাষ্ট্রপরিচালনাও ইবাদত। এতে সহায়তা করা বস্তুত উত্তম ও তাকওয়ার কাজে সহায়তার নামান্তর। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ন্যায়-নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা এবং এর জন্য চেষ্টা- সংগ্রাম চালানোও একজন মুসলমানের কর্তব্য। কুরআন-হাদিছে এর বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
রচনাবলি
জীবনী ও ইতিহাস গ্রন্থে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর রচনাবলি অনেক বিদ্যমান; কিন্তু অধিকাংশ দুর্লভ। ‘কাশফুয্ যুনূন’ গ্রন্থকার লিখেছেন। তাঁর রচনা তিনশত খণ্ডে বিস্তৃত।
তার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল ১। কিতাবুল আসার। এটা ফিকহি দলিলাদির অমূল্য এক ভান্ডার। এর সিংহভাগ ইমাম আবু হানিফা থেকে বর্ণিত। এটা ইদারায়ে ইহয়ায়ুল মা’রিফ আনুমানিয়া, হায়দারাবাদ থেকে মাওলানা নুমান সাহেব এর টীকাসহ ছাপা।
২। ইখতিলাফু আবি হানিফা ওয়া ইবনে আবি লাইলা। ইমাম আবু ইউসুফ রহ: তার উভয় উস্তাদের মতানৈক্যপূর্ণ মাসয়ালাগুলো একত্র করেছেন। সেইসঙ্গে নিজের ইতিহাস অনুযায়ী দলিল প্রমাণের আলোকে কোনো একটি অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
৩। আর রজ্জু আলা সিয়ারিল আওয়ারি। ইমাম আযম রহ.-এর কিতাবুল জিহাদ-এর কতক মাসয়ালার উপর ইমাম আওযায়ি রহ, আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। ইমাম আবু ইউসুফ রহ: কুরআন-হাদিছের আলোকে তার জবাব লিখেছেন। যেমনটি নাম দ্বারাই বোধগম্য।
৪। কিতাবুল খারাজ। খলিফা হারুনুর রশিদের আবেদনে খারাজ-জিযিয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে এ কিতাবটি রচনা করেন। যেন এটা আর্থিক লেনদেন আইন। এর রচনাশৈলিতে একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হল, নির্ভীকভাবে আইন ও দিকনির্দেশনার সাথে সমকালীন খলিফাকে সতর্ক করেছেন।
৫। কিতাবুল খারাজি ওয়াল হিয়ালি : এটাও ইমাম আবু ইউসুফ রহ:-এর রচনা বলে বর্ণিত আছে।
ইমাম আবু ইউসুফের ইলমী অনুরাগ:
ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-ই বর্ণনা করেন, একবার আমার পুত্র মৃত্যুবরণ করল। আমি তখন ইমাম আবু হানিফা -এর মজলিশে অনুপস্থিত থাকা পছন্দ করলাম না। নিজের বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশিদেরকেই কাফন-দাফনের দায়িত্ব দিলাম। আশঙ্কা করছিলাম, আমি ইমাম সাহেবের ইরশাদ ও ফয়েয থেকে বঞ্চিত হলে তো সারা জীবন সে আক্ষেপ থেকে যাবে। এটা তো তাঁর পুত্রের মৃত্যুর সময়ের ঘটনা। খোদ তাঁর মৃত্যুর সময়ের অবস্থা শুনুন। ইবরাহিম ইবনুল জারহ বর্ণনা করেন, তাঁর মৃত্যুরোগের সময় আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। তখনো ইলমি কথোপকথন চলছিল। কিছুক্ষণ অজ্ঞান থাকার পর সংজ্ঞা ফিরে পেলে আমাকে বললেন, ইবরাহিম! বাহনে চড়ে কঙ্কর নিক্ষেপ উত্তম না-কি পায়ে হেঁটে? আমি বললাম, পায়ে হেঁটে। তিনি বললেন, ভুল। আমি বললাম, বাহনে চড়ে। ইবরাহিম বলেন, আমি উঠে দরজা পর্যন্ত এসেছিলাম। ইত্যবসরে তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনতে পেলাম। [কিতাবু ইবনে আবিল আওয়াম।
ইমাম আবু ইউসুফের মৃত্যুর সনঃ
ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ ৬৭ বছর বয়সে ১৮২ হিজরি সনে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন।