সম্মানিত পাঠক, আজ আমরা জানবো হাদিসের প্রকার এবং হাদীসের পরিচয় সম্পর্কে।
হাদিস কাকে বলে? কাওলী, ফেইলী ও তাকরীরী হাদিস কাকে বলে? সহীহ হাদিস কাকে বলে ও তার হুকুম কি? হাসান হাদীস কাকে বলে ও তার হুকুম কি? যঈফ হাদিস কাকে বলে ও তার হুকুম কি? জাল হাদিস কাকে বলে? হাদিসে কুদসি কাকে বলে? মারফু হাদিস কাকে বলে? মাওকুফ হাদিস কাকে বলে? মাকতু হাদিস কাকে বলে? মুত্তাসিল হাদীস কাকে বলে? মুনকাতি হাদিস কাকে বলে? মুরসাল হাদিস কাকে বলে? মুয়াল্লাক হাদিস কাকে বলে? অত্রপোষ্ট থেকে এসব হাদীসের পরিচয় জানতে পারবেন।
ইসলামী শরীয়তের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে হাদীস। হাদীস হল পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা। সেজন্য হাদীস সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি জ্ঞান থাকা উচিত।
হাদীস কাকে বলে?
উত্তর: হাদীস শব্দের আভিধানিক অর্থ হল—কথা, বাণী, সংবাদ, বার্তা, বিষয় ইত্যাদি।
হাদিসের পারিভাষিক অর্থ—নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ, সমর্থন ও অনুমোদনকে হাদীস বলে।
হাদিসের প্রকার ও হাদীসের পরিচয় ০১:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস প্রধানত তিন প্রকার। যথা- কাওলী (বাচনিক), ফেইলী (কর্মগত), তাকরীরী (অনুমোদিত বা সমর্থিত)।
১. যে সমস্ত হাদিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখনিঃসৃত অর্থাৎ মৌখিক হাদীসকে কাওলী বলা হয়। যেমন: হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: শপথ সেই সত্ত্বার যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, তোমাদের কেউ খাটি মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তার নিকট তার জন্মদাতা পিতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র হই (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৪)।
লক্ষ্য করুন, এ হাদিস শরীফটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখনিঃসৃত। আর এ ধরনের হাদিসকেই কাওলী (قولا) বলা হয়।
২. যে সমস্ত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাজকর্ম, আচার ব্যবহার, উঠাবসা, লেনদেন ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, সেসবকে ফেইলী (فعلا) হাদিস বলা হয়। যেমন: হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, সূরা সোয়াদ এর সিজদা ওয়াজিব সিজদাসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি তিলাওয়াতের পর সিজদা করতে দেখেছি (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১০৬৯)।
দেখুন, উল্লেখিত হাদিস শরীফটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি কাজের বিবরণ রয়েছে। এ প্রকারের হাদীসকে ফেইলী হাদীস বলে।
৩. যে সমস্ত কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে করেন নি তবে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম-কে করতে দেখে সমর্থন করেছেন অথবা করতে দেখে নিষেধ করেন নি, সে হাদীসসমূহকে তাকরীরী (تقريرا) হাদিস বলে।
হাদিসের প্রকার ও হাদীসের পরিচয়: ০২
আমারা যেসব হাদীস পেয়েছি বা শুনেছি তা অবশ্যই কেউ না কেউ আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে বা বর্ণনা করেছে। এমন নয় যে আমরা সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র যবান থেকে শুনেছি বা তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন, বরং এসমস্ত হাদীস আমরা বিভিন্ন রাবী বা বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে পেয়েছি। যেমন বুখারী শরীফের হাদীস পেয়েছি ইমাম বুখারী থেকে। তিনি পেয়েছেন তাঁর শায়খ থেকে। শায়খ পেয়েছেন তাঁর শায়খ থেকে। এই পরম্পরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। তো যারা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের রাবী বা বর্ণনাকারী বলা হয়। রাবী বা বর্ণকারীদের গুণবিচার করে হাদীসের মান নির্ণীত হয়। সেজন্যে আমরা কোনো হাদীসকে সহীহ বলি। কোনো হাদীসকে হাসান বলি। কোনো হাদীসকে জয়িফ বলি। এবার আসুন আমরা জেনে নেই সহীহ হাদিস কাকে বলে, হাসান হাদিস কাকে বলে, জয়ীফ হাদিস কাকে বলে।
• সহীহ হাদিস কাকে বলে?
যে হাদীসের সনদ মুত্তাসিল হয় এবং রাবী আদেল ও পূর্ণ সংরক্ষণকারী হয়ে থাকেন এবং হাদিসটি যদি শায ও মুআল্লাল না হয় এবং সনদের আদ্যোপান্ত এরূপ থাকে তাহলে সেটাকে সহীহ হাদিস (حديث صحيح) বলে।
সহীহ হাদিস কাকে বলে সেটা সহজে বুঝার জন্যে আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক। একটা হাদিস সহীহ হওয়ার জন্যে তার মধ্যে ৫টি বিষয় থাকা আবশ্যক।
(১) হাদীসের সনদ মুত্তাসিল হওয়া: এর মানে হলো, সনদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত
প্রত্যেক বারী তাঁর স্বীয় উস্তাদ থেকে সরাসরি হাদীস রিওয়ায়াত করবে।
(২) হাদিসের রাবী বা বর্ণনাকারী আদালাত সম্পন্ন হওয়া : অর্থাৎ সনদের প্রত্যেক রাবী মুসলিম, বালিগ (পূর্ণবয়স্ক) ও আকিল (বিবেকবান) হবেন এবং তিনি ফাসিক ও অসভ্য হবেন না।
(৩)হাদিসের রাবী বা বর্ণনাকারী সংরক্ষণ শক্তি সম্পন্ন হওয়া : অর্থাৎ সনদের প্রত্যেক রাবীকেই পূর্ণ সংরক্ষণ শক্তিসম্পন্ন হতে হবে। চাই এটা স্মৃতি শক্তির মাধ্যমে হোক কিংবা লিখার মাধ্যমে।
(৪) শায না হওয়া : এর মানে কোন সিকাহ্ রাবী (নির্ভরযোগ্য) তাঁর চেয়েও
অধিক সিকাহ্ রাবীর বিপরীত রিওয়ায়াত করবেন না।
(৫) মুআল্লাল না হওয়া: অর্থাৎ এমন গোপন সূক্ষ্ম ত্রুটিকে ইল্লাত বলা হয়, যা হাদীস সহীহ্ হওয়ার ব্যাপারে অন্তরায় সৃষ্টি করে। কিন্তু বাহ্যত হাদীসটিকে ত্রুটিমুক্ত
বলে মনে হয়।
সহীহ হাদিসের উল্লেখিত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে কোনো হাদীস সহীহ হওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত পূরণ হওয়া জরুরি।
(১) সনদ মুত্তাসিল হওয়া।
(২) রাবীর ন্যায়পরায়ণ হওয়া।
(৩) রাবী পূর্ণ সংরক্ষণ শক্তিসম্পন্ন হওয়া
(৪) মুআল্লাল না হওয়া।
(৫) শায না হওয়া।
উল্লেখিত পাঁচটি শর্তের কোনো একটি শর্তও যদি কোনো হদিসে পাওয়া না যায় তাহলে সে হাদিসকে সহীহ হাদীস বলা যাবে না।
সহীহ হাদিসের হুকুম: মুহাদ্দীসগণ বলেছেন, সহীহ হাদিসের উপর আমল করা ওয়াজিব। সহীহ হাদিস শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃত। কোনো মুসলমানের জন্যে তা বর্জন করার অবকাশ নেই।
• হাসান (حسن) ঐ হাদীসকে বলে, যার সনদ মুত্তাসিল, রাবী আদালতসম্পন্ন তবে স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা রয়েছে এবং হাদীসটি শায ও মুআল্লাল হওয়ার ত্রুটি থেকে মুক্ত। অর্থাৎ হাদীস সহীহ হওয়ার সব শর্ত বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি কিছুটা দুর্বল হয় তাহলে সে হাদীসের মান সহীহ থেকে এক স্তর কমে গিয়ে হাসান হয়ে যায়।
হাসান হাদীসের হুকুম: শরীয়তের দলীল হিসেবে হাসান হাদিস সহীহ হাদীসের সমমর্যাদা সম্পন্ন। এজন্যে সমস্ত ফোকাহায়ে কেরাম একে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং এর উপর আমলও করেছেন। উসূলবিদগণও একে দলীল হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একমত। তবে সহীহ হাদিস আর হাসান হাদিসের মাঝে বৈপরীত্য দেখা দিলে সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দিতে হবে।
• জঈফ (ضعيف) হাদীস বলে যার মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তসমূহ থেকে কোনো একটি শর্ত অনুপস্থিত থাকে। পুরোপুরি পাঁচটি বিষয় তাতে পাওয়া যায় না। সেজন্য এটি তৃতীয় স্তরের হাদীস হয়ে যায়।
যঈফ হাদিসের হুকুম: যঈফ হাদিস দলীলের ক্ষেত্রে বা শরীয়তের কোনো আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। ফাযাইলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদিসের উপর আমল করা মুস্তাহাব।
• মাওযু (موضوع) বা জাল হাদিস কাকে বলে?
বানোয়াট ও মিথ্যা কথাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে চালিয়ে দেওয়া বা নিজে কোনো বিষয় রচনা করে সেটাকে হাদিস বলে চালিয়ে দেওয়াকে মাওযু বা জাল হাদিস বলে।
• হাদীসে কুদসী কাকে বলে?
উত্তর: যেসব হাদীসের শব্দ এবং ভাষা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, আর ভাব ও মর্ম আল্লাহ পাকের। আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলকে জিব্রাইল আ: এর মাধ্যমে অথবা ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে যা জানিয়ে দিয়েছেন সেটাকে হাদিসে কুদসী বলে।
• মারফু হাদিস কি?
মারফু (مرفوع) বলা হয় যে হাদীসের উৎস স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। চাই সেটা তাঁর কথা, কাজ সমর্থন বা গুণ হোক।
• মাওকুফ হাদিস কি?
উত্তর: যে হাদিসে কোনো সাহাবীর কথা কাজ বা সমর্থন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকুফ (موقوف) বলা হয়।
• প্রশ্ন: মাকতু হাদিস কি?
উত্তর: যে হাদীসে কোনো তাবেঈর কথা কাজ বা সমর্থনের বর্ণনা রয়েছে তাকে মাকতু (مقطوع) বলা হয়।
• প্রশ্ন: মুত্তাসিল (متصل) হাদীস কাকে বলে?
যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত হয়েছে, মাঝে কোনো রাবী (বর্ণনাকারী) বাদ পড়েনি বা উহ্য থাকেনি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে। মুত্তাসিল হাদীসকে মাওসুলও বলা হয়।
• প্রশ্ন: মুনকাতি (منقطع) হাদিস কাকে বলে?
উত্তর: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত হয়েনি, মাঝে কোনো রাবী বাদ পড়েছে বা উহ্য রয়েছে তাকে মুনকাতি বলা হয়।
• প্রশ্ন: মুআল্লাক (معلق) হাদিস কাকে বলে?
উত্তর: হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি প্রথমংশেই রাবীর নাম বাদ পড়ে যায় তাহলে মুআল্লাক বলে।
• প্রশ: মুরসাল (مرسل) হাদিস কাকে বলে?
উত্তর: হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি সনদের শেষাংশের রাবীর নাম বাদ পড়ে যায় তাকে মুরসাল হাদিস বলা হয়।
এসব ছাড়াও আরো বেশ কয়েকপ্রকার হাদীস রয়েছে যেমন: খবরে ওয়াহীদ, মাশহুর, মুতাওয়াতির, গরীব, আযীয, মাতরুক, মুযতারাব ইত্যাদি। হাদিসের প্রকার ও হাদীসের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে এ সংক্রান্ত কোনো কিতাবের দ্বারস্থ হোন। তাহলেই আপনি হাদিসের প্রকার হাদিসের পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাবেন।