সহীহ হাদীসের আলোকে ইসরা ও মেরাজের বিস্তারিত ঘটনা


আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য কুদরতী নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন হচ্ছে মেরাজের ঘটনা। ইসলামের ইতিহাস ও বিশ্বনবির জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হল মেরাজ। এটি বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের অনেক বড় একটি মুজিজা আর উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য অনেক বড় একটি নেয়ামত। তৎকালিন সময়ে তা ছিল সৃষ্টিজগতের সেরা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। মেরাজের আশ্চর্যজনক ও তৎপর্যপূর্ণ ঘটনায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও উচ্চ মর্যাদাই প্রকাশ পেয়েছে। মেরাজের এ ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য তার আক্বিদা-বিশ্বাসের অংশও বটে। মেরাজের অলৌকিক  ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।তবে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ নিয়ে অনেক বই প্রণীত হয়েছে। যার মধ্যে অনেক বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি করা হয়েছে। যা মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। মেরাজের সঠিক তথ্য ও ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হয় ঈমানদার মুমিন মুসলমান। সে কারণে আজ মেরাজ সম্পর্কিত সহীহ হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনা তুলে ধরবো আপনাদের মাঝে।

ইসরা মেরাজের ঘটনার সূচনা:মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর আগের এক রাত। তখন নবুওয়ত লাভের ১১তম বছর চলছে। নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) একরজনীতে ঘুমিয়ে আছেন কাবার হাতীমে। ঘুমিয়ে আছেন একরাশ দুঃখবেদনা বুকে পুষে। মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো ছিলেন যেই চাচা, তিনি মারা গেছেন। তিনি মারা গেছেন কাফির অবস্থায়। নিজের আপন চাচা, নিজের প্রিয় একজন মানুষকে জান্নাতের সঙ্গী করতে পারেননি তিনি। এর কিছুদিন পরই মারা গেছেন আপন স্ত্রী, যাঁকে বাকি সব মানুষ থেকে বেশি ভালো বেসেছেন। সেই মহীয়সী স্ত্রী, সবাই যখন নবীকে অস্বীকার করেছে- তখন তিনি বিশ্বাস করেছেন, সবাই যখন তাঁকে পরিত্যাগ করেছে- তিনি তাঁর সবটুকু দিয়ে নবীকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন। সেই পরম আপন মানুষটিও নবীকে (ﷺ) রেখে চলে গেলেন আখিরাতের অনন্ত যাত্রায়! সেই দুঃখবেদনা বুকে নিয়েও নবী (ﷺ) গিয়েছিলেন তায়েফে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে। তারা তাঁকে রক্তাক্ত করে ফিরিয়ে দিয়েছে। শারিরিক যন্ত্রণা তাঁর মানসিক যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে যায় নি। পরপর তিনটি বড়ো আঘাত বুকে নিয়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন তিনি। বুকজুড়ে শূন্যতা বৈ কিছু নেই! কুরাইশদের উপর্যুপরি অত্যাচার, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর বিরোধিতা তো সবসময় থেকেই আছে। এমনি এক সময়ে কাবার হাতীমে ঘুমিয়ে আছেন প্রিয় নবী (ﷺ)। 


তাঁর শূন্য বুক ভরিয়ে দিতে, তাঁর ব্যাথাকে প্রশমিত করতে, তাঁর মুখের হাসি ফিরিয়ে দিতে ঘটলো এক অলৌকিক ঘটনা, একটি ভ্রমণ! যা বদলে দিয়েছিলো প্রেক্ষাপট, নবীমনকে দিয়েছিলো প্রশান্তি, আর তাঁর উম্মতকে দিয়েছে বড়োসড়ো কিছু উপহার! 
কাবার হাতিমে ঘুমিয়ে থাকা নবীকে জাগিয়ে তুললেন জীব্রিল আ.। তাঁর হাতে ছিলো জমজমের পানিভর্তি স্বর্ণের পেয়ালা। নিজ হাতে দ্বিতীয়বারের মতো রাসূল (ﷺ) এর বক্ষ বিদীর্ণ করলেন জীব্রিল আ.। বের করলেন তাঁর হৃদয়। তারপর তা ধুলেন জমজমের পবিত্র পানি দ্বারা , যাতে তাঁর হৃদয় ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ হয় এবং দৃঢ় হয়৷ কেননা যা তিনি দেখতে চলেছেন, তা এই পৃথিবীর কোন জীবিত মানুষ কখনো দেখেনি। তিনি দেখতে চলেছেন গায়েবী জগতের সব দৃশ্য, যা দুর্বলহৃদয় মানুষ সহ্য করতে পারবে না। তাই তাঁর হৃদয়কে ঈমানে পরিপূর্ণ ও দৃঢ় করে দিলেন জীব্রিল আ.। 


তারপর এলো একটি প্রাণী৷ সেটি গাধার চেয়ে খানিকটা বড়ো ছিলো, খচ্চরের চেয়ে ছোটো। সেটি ছিলো সাদা রঙের, নাম ছিলো বোরাক। সেটি ভীষণ দ্রুতগামী, এক লাফে দৃষ্টিসীমার শেষ অবধি চলতে পারে। এই দ্রুতগামী প্রাণিটির ওপর রাসূল (ﷺ) কে নিয়ে জীব্রিল আ. চড়ে বসলেন। বোরাক শুরুতে তার ওপর চড়তে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলো, অসুবিধা সৃষ্টি করছিলো। জীব্রিল আলাইহিসসালাম তাকে বললেন, “তুমি কেন এরকম আচরণ করছো (রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) এর সাথে) ? অথচ, তাঁর চাইতে উত্তম কেউ তোমার ওপর কখনো সওয়ার হয়নি। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বোরাক ঘামতে লাগলো এবং শান্ত হলো। এরপর রাসূল (ﷺ) বোরাকে চড়ে বসলেন এবং তাঁর যাত্রা শুরু হলো। 
বোরাক এতদ্রুত চলছিলো যে, তার এক পদক্ষেপ দৃষ্টিসীমা অবধি নিয়ে যায়। একটি বর্ণনায় এসেছে, বোরাকে চলাকালীন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মূসা (আলাইহিসসালাম) কে কবরের ওপর সালাত আদায়রত দেখেছেন। যাহোক, বোরাকে চড়ে রাসূল (ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাসে এসে পৌঁছান। তারপর তিনি একটি খুঁটির সঙ্গে বোরাককে বেঁধে রাখেন। এই খুঁটিটিতে অন্যান্য নবীরাও তাঁদের জন্তুদের বাঁধতেন। এরপর তিনি মাসজীদে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন নবীদের দেখতে পান৷ 
সেখানে ছিলেন মূসা (আলাইহিসসালাম)। তাঁর গায়ের রঙ ছিলো বাদামী, চুল ছিলো কোঁকড়ানো। তিনি ছিলেন লম্বা গড়নের, সুঠামদেহী। তাঁকে দেখতে শানু’আহ গোত্রের লোক মনে হচ্ছিলো।


 এরপর দেখলেন ঈসা ইবনু মারইয়ামকে (আলাইহিসসালাম)। তিনি ছিলেম মধ্যম গড়নের, তাঁর গায়ের রঙ ছিলো সাদা, তাঁর চুলগুলো ছিলো সোজা। রাসূল (ﷺ) বলেন, তাঁর চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো যেন তিনি সবেমাত্র গোসল করে বের হয়েছেন। তাঁর চেহারা উরুয়াহ ইবনে মাসঊদ আশ শাকাফীর মতো বলে তিনি উল্লেখ করেন।  মসজিদে তিনি ইবরাহীমকেও (আলাইহিসসালাম) দেখতে পান৷ রাসূল (ﷺ) বলেন, তাঁর সন্তানদের মধ্যে আমার সঙ্গেই তাঁর সর্বাধিক সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ ইবরাহীম (আলাইহিসসালাম) আর রাসূল (ﷺ) কাছাকাছি রকমের ছিলেন দেখতে। 


রাসূল (ﷺ) মসজিদে প্রবেশ করেই দু রাকাত সালাত আদায় করেন৷ বাকি নবীরা তখন সালাতে দন্ডায়মান ছিলেন। এরপর জামায়াতের সময় এলে রাসূল (ﷺ) কে সবাই ইমামতির জন্য এগিয়ে দেন! সকল নবী তাঁর পেছনে সালাত আদায় করেন। কোনো কোনো রেওয়ায়েতে আছে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর সবাই রাসূল (ﷺ) এর পেছনে সালাত আদায় করেছিলেন সে রাতে। এ থেকেই রাসূল (ﷺ) এর মর্যাদা সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়। তিনি হলেন সকল নবীর ঈমাম(সাইয়্যিদুল মুরসালিন), সকল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ। 
এরপর জীব্রিল (আলাইহিসসালাম) রাসূল (ﷺ) এর নিকট দুটি পেয়ালা নিয়ে আসেন। একটিতে ছিলো দুধ, অপরটিতে মদ। একটি নিতে বলা হলে রাসূল (ﷺ) দুধের বাটিটি নিলেন এবং পান করলেন। জীব্রিল (আলাইহিসসালাম) বললেন, আপনি ফিতরাত (স্বভাবগত) গ্রহণ করেছেন। মদের পাত্র গ্রহণ করলে আপনার উম্মত ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো। এই পর্যন্ত ভ্রমণটুকুকে বলা হয় ইসরা অর্থাৎ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। বিশেষত বায়তুল্লাহ শরিফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়ে থাকে। এরপর শুরু হয় মূল পর্ব ‘মিরাজ’ অর্থাৎ উর্ধ্বগমন।

মেরাজের সংজ্ঞা: মেরাজ কাকে বলে?মিরাজের পর্ব শুরুর পূর্বে মিরাজ কাকে বলে তার একটা সংজ্ঞা জেনে নিলে সহজে বুঝতে পারব।মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। পরিভাষায় মেরাজ হলো, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইলের (আ.) সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ; মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসা।

মেরাজের ঘটনা:বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে জীব্রিল (আলাইহিসসালাম) আল্লাহর রাসূলকে (ﷺ) নিয়ে প্রথম আসমানের দরজায় এসে দাঁড়ান। দ্বাররক্ষী জিজ্ঞেস করে, কে? জীব্রিল উত্তর দেন, “আমি জীব্রিল”, এরপর আবার প্রশ্ন আসে, “আপনার সঙ্গে কে রয়েছে?”, জীব্রিল উত্তর দিলেন, “আমার সঙ্গে রয়েছেন রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)”, প্রশ্ন এলো, “তাঁর যাত্রা কি শুরু হয়েছে?”, উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছে”। এরপর দ্বাররক্ষী দরজা খুলে দিলেন এবং বললেন, “তাঁকে অভিনন্দন, তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক!” 
প্রথম আসমানে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যাঁকে দেখলেন তিনি হচ্ছেন আদম (আলাইহিসসালাম)। তিনি একবার তাঁর ডান দিকে তাকাচ্ছিলেন আর হাসছিলেন, এরপর তাঁর বাম দিকে তাকাচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন। রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, “ইনি কে?” জীব্রিল বললেন, “ইনি হচ্ছেন আপনার পিতা আদম (আঃ), তিনি ডান দিকে তাকিয়ে তাঁর জান্নাতী সন্তানদের দেখতে পাচ্ছেন, আর বাম দিকে তাকিয়ে তার জাহান্নামী সন্তানদের। তাঁকে সম্ভাষণ জানান।” রাসূল (ﷺ) তাঁকে সালাম দিলেন, সালামের জবাব দিয়ে আদম (আলাইহিসসালাম) বললেন, “হে আমার উত্তম সন্তান এবং সৎ নবী, তোমাকে স্বাগতম!” 
এরপর জীব্রিল (আলাইহিসসালাম) আল্লাহর রাসূল (ﷺ) কে নিয়ে দ্বিতীয় আসমান অভিমুখে চললেন। সেখানেও দ্বাররক্ষীর সাথে একই কথোপকথন হলো। দ্বিতীয় আসমানে সাক্ষাত হলো ঈসা (আলাইহিসসালাম) ও ইহাইয়াহ (আলাইহিসসালাম) এর সঙ্গে। তাঁরা পরস্পর খালাতো ভাই ছিলেন৷ তাঁরা বললেন, “আমার সৎ (honest) ভাই এবং সৎ নবী, আপনাকে অভিনন্দন!” 
তৃতীয় আসমানে রাসূল (ﷺ) এর দেখা হলো ইউসুফ (আলাইহিসসালাম) এর সঙ্গে, যাঁকে সমস্ত সৌন্দর্যের অর্ধেক দেয়া হয়েছিলো। তিনিও তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। 


চতুর্থ আসমানে দেখা হলো ইদরীস (আলাইহিসসালাম) এর সঙ্গে, তিনিও রাসূল (ﷺ) কে অভিনন্দন জানালেন এবং মঙ্গল কামনা করলেন। 
পঞ্চম আসমানে দেখা হলো হারূণ (আলাইহিসসালাম) এর সঙ্গে। তিনিও রাসূল (ﷺ) কে অভিনন্দন জানালেন এবং মঙ্গল কামনা করলেন। 
ষষ্ঠ আসমানে দেখা হলো মূসা (আলাইহিসসালাম) এর সাথে। তিনিও রাসূল (ﷺ) কে অভিনন্দন জানালেন এবং মঙ্গল কামনা করলেন। রাসূল (ﷺ) যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন তিনি কান্না করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, “এই নবী আমার চাইতে তরুণ, কিন্তু তাঁর উম্মত আমার উম্মতের চাইতে অধিক সংখ্যক জান্নাতে যাবে!” 


এরপর জীব্রিল আলাইহিওয়াসাল্লাম রাসূল (ﷺ) কে নিয়ে সপ্তম আসমানে গেলেন। সেখানে দেখা হলো ইবরাহীম (আলাইহিসসালাম) এর সাথে। তিনি বাইতুল মামূরে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। বাইতুল মামূর হচ্ছে এমন একটি ঘর যেটি অনেকটা কা’বার মতোই। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা বাইতুল মামূর তাওয়াফ করেন। এর একবার যাঁরা তাওয়াফ করেন, তাঁরা দ্বিতীয়বার আসেন না। এটা কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে! (সুবহান-আল্লাহ) এই বাইতুল মামূরের অবস্থান একেবারে কা’বার ঠিক ওপরে বলে একটি রেওয়ায়েত আছে। তিনি রাসূল (ﷺ) কে দেখে বললেন, “হে সৎ পুত্র এবং নবী, আপনাকে অভিনন্দন!” 
এরপর রাসূল (ﷺ) কে সিদরাতুল মুনতাহা’তে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি ছিলো সপ্তম আসমানে অবস্থিত একটি গাছ। এর পাতাগুলো ছিলো হাতির কানের মতো। ফলগুলো ছিলো ‘হাজার’ নামক অঞ্চলের বড়ো পানির পাত্রের মতো। সেই গাছ থেকে এমন সব রঙ বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো যা রাসূল (ﷺ) আগে কখনো দেখেননি। অর্থাৎ দুনিয়াবী কোন রঙ ছিলোনা সেগুলো। সেই গাছের আশেপাশে উড়ে বেড়াচ্ছিলো স্বর্ণের ফড়িং! রাসূল (ﷺ) মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন সে চিত্র, যা দুনিয়ার কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোন হৃদয় দুনিয়ায় থেকে যা কখনোই অনুভব করতে পারেনি, পারবেওনা। 
সিদরাতুল মুনতাহা নামক গাছের পাদদেশে চারটি নদী বহমান। এর দুটি প্রকাশিত, বাকি দুটি অপ্রকাশিত। যাহির ও বাতিন। বাতিনী নদী দুটি ছিলো জান্নাতের নদী। আর যাহিরী নদী দুটি ছিলো নীল এবং ফোরাত। এই দুটি নদীর মূল হচ্ছে জান্নাতে। জান্নাত থেকে সৃষ্টি হয়ে কীভাবে সেগুলো পৃথিবীতে বহমান আছে, তা কেবল আল্লাহ জানেন, আল্লাহু আ’লাম। তবে এই দুইটি নদী মুসলমানদের জন্য খুবই গুরুত্ববহ। এই দুইটি নদীর তীরে বহু বছর ধরে ইসলামী সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং অবস্থান করেছে। 
এখানেই রাসূল (ﷺ) জীব্রিলকে স্বরূপে দেখতে পান। ছয়শত ডানাসহ জীব্রিল আত্মপ্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে কুর’আনে বর্ণনাও এসেছে। সূরা আন নাজমের প্রথমদিকে আল্লাহ এই বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেন। বিভিন্ন হাদীসেও এই আলোচনা এসেছে। সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে এই আয়াতগুলো নিয়ে বিতর্কও হয়েছিলো যে তিনি কি জীব্রিলকে দেখেছিলেন নাকি আল্লাহকে। এ বিষয়ে লেখাটির শেষে আলোচনা করবো ইন-শা-আল্লাহ। 


সিদরাতুল মুনতাহায় আরো যে দুয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিলো তা হলো, সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত নাযিল হয়েছিলো এবং রাসূল (ﷺ) কলমের শব্দ শুনেছিলেন। সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত সেই মহিমান্বিত দুটি আয়াত, যেগুলো রাসূল (ﷺ) আসমানেই পেয়েছিলেন। এজন্যই এ দুটি আয়াতের অনেক ফযীলাত। রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত তিলাওয়াত করবে, তার জন্য সেটাই যথেষ্ট হবে। (মুসলিম ৬/৪৩) 
এছাড়া সিদরাতুল মুনতাহায় যখন রাসূল (ﷺ) অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি কলমের শব্দ শুনতে পান। যেই কলম দিয়ে তাক্বদীর লিখিত হয়, এটা সেই কলম। এরপর তাঁর সঙ্গে আল্লাহর কথোপকথনটি সংগঠিত হয়।
আল্লাহর সঙ্গে রাসূল (ﷺ) এর ঠিক কী কী কথা হয়েছিলো তা অজানা। কিন্তু, এই কথোপকোথনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হয়েছিলো। এই কথোপকথনের মাধ্যমে আল্লাহ সালাতের ওয়াক্ত সংখ্যা ফরজ করেন। প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়। রাসূল (ﷺ) তা নিয়ে নেমে আসছিলেন। কিন্তু ষষ্ট আসমানে মূসা (আলাইহিসসালাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহর কাছ থেকে তিনি কী নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছেন? জবাবে রাসূল (ﷺ) বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত। 
এটা শুনে মূসা (আলাইহিসসালাম) বললেন, “আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান। আপনার উম্মাত পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার ক্ষমতা রাখেনা। আমি ইতোপূর্বে বনী ঈসরাইলের লোকদের দেখেছি।” এখানে লক্ষনীয় যে, মূসা (আলাইহিসসালাম) একজন অভিজ্ঞ নবী। কেননা রাসূল (ﷺ) এর আগে সবচেয়ে বড়ো উম্মাহ ছিলো তাঁর। তাই, তিনি ধারণা করতে পারছিলেন, উম্মাতে মুহাম্মাদী এতো বেশি সালাত আদায় করার ক্ষমতা রাখেনা। তাঁর কথা শুনে রাসূল (ﷺ) পুনরায় আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেন এবং ওয়াক্ত সংখ্যা কমানোর আবেদন করলেন। পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হলো। সেটা নিয়েই তিনি ফিরলেন। 


কিন্তু এবারো মূসা (আলাইহিসসালাম) তাঁকে ফেরত পাঠালেন। এভাবে ফেরত পাঠাতে থাকলেন যতক্ষণ না রাসূল (ﷺ) পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে ফিরে এলেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে ফিরে আসার পর মূসা (আলাইহিসসালাম) আবারো বললেন, “আপনার রবের কাছে ফিরে যান, আপনার উম্মাত এতো সালাত আদায় করার ক্ষমতা রাখে না।” কিন্তু বারবার আসা যাওয়ার কারণে রাসূল (ﷺ) লজ্জাবোধ করছিলেন। তাই তিনি আর আল্লাহর কাছে ফের‍ত যেতে পারলেন না। 
এই মূহুর্তে আল্লাহ বলে উঠলেন, “হে মুহাম্মাদ, দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফর‍য করা হলো এবং প্রতিটি সালাতের জন্য দশ গুণ সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। সুতরাং, এর মোট পরিমাণ পঞ্চাশই থাকলো। কেউ যদি একটি ভালো কাজের ইচ্ছা করে, কিন্তু বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে তার আমলনামায় একটি আমলের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। যদি বাস্তবায়িত করে তবে দশটি আমলের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। কেউ যদি কোন খারাপ কাজ করার ইচ্ছে করে, কিন্তু কাজটি না করে, তবে কোন পাপা তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হবেনা। আর যদি কাজটি করে ফেলে, তবে একটিমাত্র পাপ লিপিবদ্ধ করা হবে।” 
এরপর আসে সেই কাঙখিত মূহুর্ত। যা দুনিয়ায় থাকা কারো জন্য অসম্ভব। রাসূল (ﷺ) তার দুনিয়াবি চোখে দেখলেন অসীম সৌন্দর্য্যের জান্নাত আর অপরিসীম দুঃখকষ্টের জাহান্নাম। জান্নাত-জাহান্নাম দেখা সম্পর্কে দুয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। জান্নাতের তাবুগুলো মণিমুক্তার এবং মাটি মেশকের। 

জাহান্নামের দৃশ্যও দেখলেন রাসূল (ﷺ)। কিছু লোকের হাতে তামার নখ ছিলো। সেই নখ দিয়ে তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুক খোঁচাচ্ছিলো। রাসূল (ﷺ) জীব্রিল (আলাইহিসসালাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?” জীব্রিল বললেন, “এরা হচ্ছে তারা, যারা গীবত করতো ও অন্যদের মর্যাদাহানি করতো।” 
এরপর তিনি দেখলেন কিছু লোকের পেট এতো বড়ো যে তারা নড়তে চড়তে পারছেনা। অন্য জাহান্নামীরা তাদেরকে পিষ্ট করে যাচ্ছে। রাসূল (ﷺ) জীব্রিলকে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?” জীব্রিল বললেন, “এরা হলো সুদখোর।” 
ইয়াতিমের সম্পদ যারা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেছে, তাদের ঠোঁট ছিলো উটের ঠোঁটের মতো। সেই ঠোঁট দিয়ে তারা পাথরের মতো করে অঙ্গার প্রবেশ করাচ্ছে আর সেটা তাদের গুহ্যদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যিনাকারীদের সামনে ভালো এবং পঁচা গোশতো রাখা হয়েছিলো। তারা বসে বসে পঁচা গোশতো খাচ্ছিলো। (ইবনে হিশাম) 


সেদিন রাতে রাসূল (ﷺ) জাহান্নামের দ্বাররক্ষী মালিককেও দেখেছিলেন। তাকে সৃষ্টির পর থেকে সে কখনো হাসেনি। এমনকি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে দেখেও সে একটুও আনন্দিত হয়নি। শুকনো মুখে সালাম দিয়েছে কেবল। সেদিন রাতে রাসূল (ﷺ) দাজ্জালকেও দেখেছিলেন। 
এবার ফেরার পালা। রাসূল (ﷺ) জীব্রিলকে সঙ্গে করে নেমে আসেন বাইতুল মুকাদ্দাসে। সেখান থেকে বোরাকে চড়ে ফিরে আসেন বাইতুল্লাহ শরীফে। এই ফিরে আসার পথেও একটি ঘটনা আছে। ফেরার পথে তিনি তিনটি মক্কাগামী কাফেলা দেখতে পান। এর মধ্যে একটি কাফেলার উট হারিয়ে গিয়েছিলো, সেই উটের খোঁজ বলে দেন তিনি। এছাড়াও একটি কাফেলা থেকে পানিও পান করেন। এরপর ফিরে আসেন বাইতুল্লাহ-তে। তারপর ঘুমিয়ে পড়েন। 
পরদিন সকালবেলা। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। উঠে হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। কালকে রাতে যে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি মানুষকে কীভাবে বলবেন এ নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়লেন। দুঃশ্চিন্তায় তার মুখ শুকনো হয়ে রইলো। তখনি কা’বার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো আল্লাহর শত্রু আবু জেহেল। রাসূল (ﷺ) কে শুকনো মুখে বসে থাকতে দেখে সে ব্যঙ্গ করে বললো, “আবার কিছু ঘটেছে নাকি? তুমি এভাবে বসে আছো কেন?” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ ঘটেছে। কালকে রাতে আমি বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়েছিলাম।” আবু জেহেল বললো, “আর তারপর তুমি এখন আমার সামনে বসে আছো? এটা বলছো?” রাসূল (ﷺ) উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ।” 
আবু জেহেল ভাবলো এটাই মুহাম্মাদকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার উত্তম সুযোগ। তাই সে বললো, “আমি যদি সবাইকে ডেকে আনি, তাদের সামনেও কি তুমি এই কথা বলবে?” রাসূল (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ বলবো।” তারপর আবু জেহেল চিৎকার করে ডাকতে লাগলো সবাইকে, “হে বনী আবদে মানাফ, শোনো সবাই…” আবু জেহেলের ডাক শুনে সবাই বেরিয়ে এলো। আবু জেহেল বললো, “মুহাম্মাদ তোমাদের কিছু বলবে।” সবাই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আবু জেহেল কীনা মুহাম্মাদের বক্তব্য শোনানোর জন্য সবাইকে ডেকেছে, আবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে! নিশ্চয়ই চমকপ্রদ কিছু ঘটতে চলেছে! 


এরপর রাসূল (ﷺ) বললেন, “কাল রাতে আমি বাইতুল মুকাদ্দাসে ভ্রমণ করেছি।” তারপর তারা বললো, “এরপর এখন তুমি আমাদের সামনে বসে আছো এমনটা বলছো?” রাসূল (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ”। এবার উপস্থিত সবার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। এদের মধ্যে কিছু লোক আছে, যারা জানে মুহাম্মাদ কখনো মিথ্যা বলেন না। তাই তারা মাথায় হাত দিয়ে ফেললো। ভীষণ রকম অপ্রস্তুত বোধ করলো তারা। আর কিছু মানুষ হাসতে শুরু করলো। প্রযুক্তির যুগে থাকা পাঠকের যদি এটা বুঝতে কষ্ট হয় তবে বলি, বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসের দূরত্ব তখনকার সময়ের জন্য মাসের দূরত্ব। যেতে একমাস, আসতে একমাস। সেই দূরত্ব মুহাম্মাদ এক রাতে পার করেছে শুনে সবাই অবিশ্বাসই করলো বলাবাহুল্য। একজন তো ছুটলো আবু বকর (রা) কে খবর দিতে। 
এর মাঝে কুরাইশদের মধ্যকার এক জ্ঞানী লোক যে বাইতুল মুকাদ্দাস দেখেছে, সে এগিয়ে এলো। তারপর সে রাসূল (ﷺ) কে সেটার বিবরণ দিতে বললো। এদিকে রাসূল (ﷺ) গিয়েছিলেন রাত্রিবেলা। তাই তিনি ভালো করে সবকিছু দেখতে পান নি, তাছাড়া দেখলেও এক দেখায় সবকিছু মনে রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায়  আবু তালিবের ছেলে আকীলের ঘরের ওপর বাইতুল মুকাদ্দাসের ছবি ফুটে উঠলো। সেই ছবি দেখে রাসূল (ﷺ) একেবারে খুঁটিনাটি বর্ণনা দিলেন। শুনে সেই লোক বললো, “মুহাম্মাদ সত্যি বলেছে।” 
কিন্তু কাফিররা এতেও সন্তুষ্ট হলো না। তারা আরো প্রমাণ চাইলো। এরপর রাসূল (ﷺ) সেই তিনটি কাফেলার কথা বললেন। আবু জেহেল বললো, “তবে তো কাফেলা তিনটির সহসাই ফেরার কথা।” তাই তারা কাবার পাশে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই তিনটি কাফেলা ফিরলো। কিন্তু কাফিররা বিশ্বাস করলো না। আবু জেহেল বললো, “এটা অবশ্যই জাদুবিদ্যা!” এটার একটাই অর্থ, হাজারো নিদর্শন দেখানো হলেও অবাধ্যরা অবাধ্যই থাকবে। 


এদিকে যে লোক আবু বাকার (রা) এর কাছে গিয়েছিলো, সে ইতোমধ্যে পৌঁছে আবু বাকারকে বললো, “শুনেছো? মুহাম্মাদ নাকি এক রাতে বাইতুল মুকাদ্দাস গিয়ে সেখান থেকে আবার ফিরে এসেছে। তুমি কি এটা বিশ্বাস করো?” আবু বাকার (রা) বললেন, “তুমি কি নিশ্চিত রাসূল (ﷺ) এটা বলেছেন? যদি তিনি এ কথা বলে থাকেন, তবে তিনি সত্য বলেছেন।” লোকটি বললো, “তুমি কি এটাও বিশ্বাস করো তিনি এক রাতেই সিরিয়া গিয়ে আবার মক্কায় ফিরে এসেছেন?” আবু বাকার (রা) বলেন, “আমি এর চেয়েও বড়ো জিনিস বিশ্বাস করি যে, তাঁর নিকট আসমান থেকে ওহী আসে।” এই ঘটনার পর আবু বাকার (রা) ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে ভূষিত হন, যার অর্থ ‘বিশ্বাসী’। 
মি’রাজের সত্যতা নিয়ে একটি অসাধারণ ঘটনাও রয়েছে। ইবনে কাসীরে এটি বর্ণণা করেছেন দালালিয়ুন নবুয়াহ নামক গ্রন্থ থেকে। 
রাসূল (ﷺ) দাহইয়া ইবনে খালিফা (রা) কে পত্রসহ দূত হিসেবে রোম সম্রাট কাইসারের নিকট প্রেরণ করেন। তিনি সম্রাটের নিকট পৌঁছালে সম্রাট সিরিয়ায় অবস্থানরত আরব বণিকদেরকে তার দরবারে হাযির করেন। এদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব (রা) ও ছিলেন। সাথে অন্যান্য কাফিররাও ছিলো। আবু সুফিয়ানের নিজের ভাষ্য এমন যে, তিনি রাসূল (ﷺ) কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন। কিন্তু তিনি তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তাঁর মাথায় আসে মি’রাজের ঘটনা। তখন তিনি বলে ওঠেন, “সম্রাট, মোহাম্মাদ একজন মিথ্যাবাদী। তিনি বলেছেন তিনি এক রাতে মক্কা থেকে আপনার এই মসজিদে এসেছেন এবং ফজরের পূর্বেই মক্কায় ফিরে গেছেন।” এই কথা শুনেই বাইতুল মুকাদ্দাসের পাদ্রী বলে উঠলেন, “এই ঘটনা সত্য, ঐ রাতের ঘটনা আমার জানা আছে।” তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন। “আমার দায়িত্ব এবং অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো যে যতক্ষণ না বাইতুল মুকাদ্দাসের সবগুলো দরজা বন্ধ করি, আমার ঘুম আসেনা। সেদিন রাতে একটি দরজা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিলো না। আমি আমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও দরজাটি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলাম। এরপর আমি অন্যান্য কর্মচারীদের ডাকলাম, তারা সহ চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম। মনে হচ্ছিলো আমরা একটা পাহাড়কে তার জায়গা থেকে সরানোর চেষ্টা করছি। এরপর আমরা একজন কাঠমিস্ত্রীকে ডাকলাম। সেও অনেকক্ষণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। অবশেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম দরজাটা এভাবেই থাকুক, সকালে দেখা যাবে। পরদিন সকালে আমি দেখলাম দরজায় পাথরে একটি ছিদ্র, যেন সেখানে কোন জন্তু বাঁধা হয়েছিলো। আমি তখন লোকদেরকে বললাম, এখানে কাল রাতে নিশ্চয়ই কোন নবী এসেছেন, এবং তিনি সালাত আদায় করেছেন।” এই ঘটনাটি মি’রাজের ঘটনার সত্যতার একটি বড়ো প্রমাণস্বরূপ। 


এবার আসি মি’রাজ নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণায়। কিছু ধারণা ইখতিলাফ থেকে এসেছে, কিছু তৈরি হয়েছে গল্প-গুজবের মাধ্যমে। 
১. রাসূল (ﷺ) কি আল্লাহকে দেখেছেন?উত্তর হচ্ছে না। তিনি আল্লাহকে দেখেন নি। তবে আল্লাহর নূর দেখেছিলেন। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস আছে। আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক (রহ) আবু যার (রা) কে বলেন, আমি যদি রাসূল (ﷺ) কে দেখতাম, তবে একটি কথা জিজ্ঞেস করতাম। আবু যার (রা) বললেন, “কী সেটি?” ইবনে শাকীক বললেন, “তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন কীনা এটি।” আবু যার (রা) বলেন, “আমি রাসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছেন, আমি তাঁর নূর দেখেছিলাম, তাঁকে আমি কীভাবে দেখতে পারি?” (মুসলিম ১/১৬১) 
অর্থাৎ, রাসূল (ﷺ) আল্লাহকে দেখেননি। তাঁর নূর দেখেছেন। এ সম্পর্কে আরেকটি ঘটনা আছে। একবার আয়িশা (রা) দারস দিচ্ছিলেন। মাসরূক (রহ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “রাসূল (ﷺ) আল্লাহকে দেখেছিলেন কী?” আয়িশা (রা) বললেন, “সুবহান-আল্লাহ! তোমার কথা শুনে আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে।” তখন মাসরূক বললেন, “তাহলে সূরা নাযমঃ১৮ কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?” “সে তো তার রবের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিলো!” তখন আয়িশা (রা) বলেন, তিনটি কথা যে বলে সে মিথ্যা বলে, ১. রাসূল (ﷺ) আল্লাহকে দেখেছেন ২. রাসূল (ﷺ) ওহী গোপন করেছেন এবং ৩. তিনি ঐ পাঁচটি বিষয় জানতেন যা একমাত্র আল্লাহ জানেন। 
এরপর তিনি বলেন, “তবে হ্যাঁ, তিনি জীব্রিল (আ) কে তাঁর আকৃতিতে দু’বার দেখেছেন।” (তিরমিযী ৯/১৬৭)

অর্থাৎ, সূরা নাজমের প্রথমদিকের আয়াতগুলোতে জীব্রিল (আ) কে দেখার কথা বলা হয়েছে, আল্লাহকে নয়। এ থেকে বোঝা যায়, রাসূল (ﷺ) আল্লাহকে দেখেননি। আল্লাহকে দুনিয়ায় থাকা অবস্থায় দেখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র জান্নাতেই তাঁর দেখা মিলবে ইন-শা-আল্লাহ। 
২. মি’রাজ কি স্বপ্নযোগে হয়েছিলো? এটি নিয়ে তেমন কোন ইখতিলাফ নেই। কিন্তু অনেকেই ধারণা করে থাকেন যে, মি’রাজ স্বপ্নযোগে হয়েছিলো। কিন্তু মিরাজের ঘটনার দিকে একটু সতর্ক দৃষ্টি দিলেই আমরা বুঝতে পারবো মিরাজ হয়েছিলো সশরীরে, স্বপ্নে নয়। ইসরা ও মিরাজের ঘটনা স্পেশালি যে আয়াতে বলা হয়েছে তা হচ্ছে, সূরা ‘ইসরা’ বা ‘বনী ঈসরাইল’ এর প্রথম আয়াতে। 
আল্লাহ বলছেন, سُبْحَٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِۦ لَيْلًا مِّنَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ إِلَى ٱلْمَسْجِدِ ٱلْأَقْصَا ٱلَّذِى بَٰرَكْنَا حَوْلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنْ ءَايَٰتِنَآ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ
“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।” 
লক্ষ্য করুন, এই আয়াত শুরু হচ্ছে ‘সুবহানাল্লাযী’ শব্দটি দিয়ে। এই শব্দটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। আল্লাহ এই একটি জায়গায় নিজের গুণের প্রতি জোর দিতে গিয়ে এমন একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কেন? কেন তিনি এমন করে শব্দ প্রয়োগ করলেন? কারণ একটাই, মিরাজের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বোঝাতে। এটি যে কোন সাধারণ ঘটনা নয়, সেটা ইঙ্গিত দিতে। এই ইসরা কিংবা মি’রাজ যদি স্বপ্নেই ঘটে থাকতো, তবে এটিকে আল্লাহ কুর’আনে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে না। কেননা তখন এটি হয়ে যেতো একটি সাধারণ ঘটনা। কুর’আনের বেশ কিছু জায়গায় মি’রাজকে নির্দেশ করে আয়াত এসেছে। উল্লেখযোগ্য হলো- সূরা নাজমঃ১৭,১৮, সূরা মারইয়ামঃ৫৭, সূরা সাজদাহঃ২৩, সূরা ইসরাঃ৬০। এছাড়া মি’রাজ যদি স্বপ্নেই ঘটতো, তবে রাসূল (ﷺ) পেরেশান হতেন না এটা প্রকাশ করার ব্যাপারে। কেননা স্বপ্নে তো মানুষ সারাবিশ্বও ঘুরে চলে আসতে পারে, এটা অবিশ্বাস করার মতো কিছু নয়। কিন্তু কুরাইশরা রাসূল (ﷺ) কে অবিশ্বাস করেছিলো। অর্থাৎ ইসরা এবং মিরাজ সশরীরেই ঘটেছিলো। 
৩। আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনই কি তাশাহুদে উঠে এসেছে? এ প্রসঙ্গে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনে সালাত ফরজ হওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু রাসূল ﷺ স্পষ্ট করে জানান নি। এরকম আরো অসংখ্য গল্প মি’রাজ সম্পর্কে প্রচলিত আছে। যেমন- আল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাসূল (ﷺ) জুতা খুলতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে জুতা পরেই আসতে বলেন। এরকম আরো অনেক গল্পই প্রচলিত যেগুলোর কোন সহীহ রেওয়ায়েত পাওয়া যায় না। 
আজকের এই লেখাটিতে আমি শুধুমাত্র সহীহ বর্ণনাগুলো থেকে ঘটনাগুলো তুলে আনার চেষ্টা করেছি। দুর্বল বর্ণনাগুলো না আনার চেষ্টা করেছি। এই ব্যাপারে সহায়তা পেয়েছি ড. ইয়াসীর ক্বাদীর লেকচার সিরিজ থেকে। এরপর দেখেছি তাফসীর ইবনে কাসীর ১২ তম খণ্ড এর ‘সূরা ইসরা’ এর প্রথম আয়াতের সুবিশাল তাফসীর। দেখেছি ছফীউদ্দিন মোবারকপুরী রচিত আর-রাহীকূল মাখতুম। তাই এই লেখায় কোথাও কোন বিচ্ছিন্নতা কিংবা কোন বর্ণনা দুর্বল পেলে অবশ্যই জানাবেন। এমনকি এর বাইরে কোন সহীহ বর্ণনা আছে, যেটি আমার লেখায় আসেনি, তেমন কোনো বিষয় থাকলে কমেন্টে জানাবেন। 
তথ্যসূত্রঃ মুসলিম ১/১৪৫, আহমাদ ৩/১৪৮,তিরমিযী ৩১৩১, আহমাদ ৩/২২৪, আবু দাঊদ ৪৮৭৮, আহমাদ ৩/১২০, মুসলিম ২৩৭৫, আহমাদ ৪/২০৮, মুসলিম ১/১৫১, ফাতহুল বারী ১/৫৪৭, ৩/৫৭৬, ৬/৪৩১, মুসলিম ১/১৪৮, মুসলিম ১/১৬১, আহমাদ ৫/১৪৭, আহমাদ ৩/৩৭৭, বুখারী ৪৭১০, মুসলিম ১৭০, আহমাদ ১/৩৮৪, নাসাঈ ১১৪৮৪,  আহমাদ ১/৩০৯, নাসাঈ ১১২৮৫, ফাতহুল বারী ৬/৪৯৩, মুসলিম ১/১৫৪, মুসলিম ১/১৫৬
লেখক: আসিফ মাহমুদসম্পাদনা: তাজুল ইসলাম মিসবাহ।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *