প্রিয় পাঠক, গত পর্বে আমরা দাওরায়ে হাদীসের কিতাব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলাম। আজ আপনাদেরকে মেশকাত জামাতের কিতাব সম্পর্কে ধারণা দেব।
মিশকাত জামাতের পরিচিতি:
মিশকাত জামাত হচ্ছে কওমি মাদ্রাসার চতুর্দশ শ্রেণী। যা স্নাতক-২য় বর্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাকে আবার জামাতে ফজিলতও বলা হয়। মিশকাত হচ্ছে দাওরায়ে হাদীসের পূর্ববর্তী ক্লাস।
এই জামাতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হতে হয়। মিশকাত জামাত ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবীয়া’ এর অন্তর্ভুক্ত।
মিশকাত জামাতে যে বিষয়সমূহ পড়ানো হয় তা হলো—১. হাদিস ২. তাফসির ৩. ফিকহ ৪. উসুলুত তাফসির ৫. উলুমুল হাদিস ৬. ইলমুল কালাম ৭. ইসলামি অর্থনীতি ৮.ইতিহাস।
মিশকাত জামাতের কিতাবসমূহ ও তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
মিশকাত জামাতের মতন:
১। আশরাফুল হিদায়া ১ম খন্ড
২। আশরাফুল হিদায়া ২য় খন্ড
মিশকাত জামাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব হলো ‘আশরাফুল হিদায়া’। আশরাফুল হেদায়া কিতাবটি হানাফি মাযহাবের এক অমর গ্রন্থ। ফিকহে হানাফির প্রসিদ্ব ও গ্রহনযোগ্য একটি কিতাব। আশরাফুল হিদায়া কিতাবটি আরবি ইবারতের সহিত পড়তে পারা, বিশুদ্ব অনুবাদ করতে পারা, ইস্তেলাহ বা পারিভাষিক অর্থ বুঝা এবং এ কিতাবের প্রতিটি মাসআলা আয়ত্ব করা ও অন্যকে বুঝানোর মতো দক্ষতা অর্জন করা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্যে অপরিহার্য। এ কিতাবটি ভালোভাবে আয়ত্ব করতে না পারলে যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হওয়া যায় না।
আশরাফুল হিদায়া কিতাবটি মূলত চারখন্ডে। আশরাফুল হিদায়া এর প্রথম দু’খন্ডকে ‘হেদায়া আওয়ালাইন’ বলা হয়। আর শেষ দুই খন্ডকে ‘হেদায়া আখিরাইন’ বলা হয়। হিদায়া আওয়ালাইন অর্থাৎ হেদায়ার প্রথম দুই খন্ড জালালাইন জামাতে পড়ানো হয়। আর ‘হেদায়া আখেরাইন’ অর্থাৎ হেদায়া শেষ দুইখন্ড মিশকাত জামাতে পড়ানো হয়। আশরাফুল হেদায়া এর সম্মানিত লেখকের নাম: আল্লামা আবুল হাসান বুরহানুদ্দীন আলী বিন আবু বকর আল মুরগিনানী রহ:।
হেদায়া সালেস / হেদায়া ৩য় খন্ডে যা যা রয়েছে— কিতাবুল বুয়ূ, ক্রয়-বিক্রয়ের নীতিমালা, ইসলামী অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য,
হেদায়া রাবে’/ হেদায়া ৪র্থ খন্ডে যা যা রয়েছে— কিতাবুশ শোফা, (অগ্রক্রয় সংক্রান্ত/ স্হাবর সম্পত্তি সম্পর্কে ইসলামী নীতিমালা) কিতাবুল কিসমাহ,কিতাবুল মুযারাআহ, কিতাবুল মুসাকাত, কিতাবুল উযহিয়্যা, কিতাবুল কারাহিয়্যাহ।
৩। মিশকাতুল মাসাবীহ ১ম খন্ড
৪। মিশকাতুল মাসাবীহ ২য় খন্ড
মিশকাতুল মাসাবীহ। ইহা একটি হাদিসের কিতাব। ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ নাম দেখে একটি কিতাব মনে হলেও মূলত এটি দুটি কিতাবের সমন্বয়ে রচিত। যার একটি হচ্ছে ‘মাসাবীহ’। মাসাবীহ এর লেখক: ইমাম আল বাগাভী (৪৩৬-৫১৬ হিজরি)। দ্বিতীয়টির নাম হচ্ছে—মিশকাত। মিশকাতের লেখকের নাম: শায়েখ ওয়ালী উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল খতীব আল আমরী আত তিবরিয়ী (ওফাত আনুমানিক ৮০০ হিজরির শেষ দিকে)। প্রথম দিকে দুটি আলাদা কিতাব ছিল, পরবর্তীতে একত্র করা হয়। যার নাম দেওয়া হয় মিশকাতুল মাসাবীহ। এটিতে বুখারী ও মুসলিমের রেফারেন্সে হাদীস সংকলন করা হয়েছে। যেগুলোকে মিশকাতের ভাষায় মুত্তাফাকুন আলাইহি বলে। এছাড়া আলাদাভাবে অন্যন্য কিতাব থেকে হাদিস সংকলন করেছেন ও সেগুলোর প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। মিশকাত শরীফে হাদীস সংখ্যা ৬২৯৪টি। কিতাবটি দুইভাগ করে পাঠদান করা হয়। প্রথমভাগ কিতাবুল ইমান। দ্বিতীয় ভাগ কিতাবুন নিকাহ। মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবটি পাঠগ্রহণের ফলে দাওরায়ে হাদিসের কিতাবগুলো বুঝতে সুবিধা হয়। মিশকাতুল মাসাবীহ এর মিশকাত থেকেই এই জামাতের নাম হয়—মিশকাত’।
৫। নুখবাতুল ফিকার (হাদীসের নীতি শাস্ত্র)।
উসূলুল হাদীস হলো হাদিস শাস্ত্রের মূলনীতি। হাদীসশাস্ত্রের গ্রামার বা ব্যাকরণ। হাদীস শাস্ত্রকে ত্রুটিমুক্ত রাখতেই এই শাস্ত্রের জন্ম। কেননা উসূলুল হাদীসের মাধ্যমেই কোন হাদীস নির্ভরযোগ্য, কোন হাদীস দুর্বল, কোন হাদীস বিশুদ্ধ, কোন হাদীস বিশুদ্ধ নয় তা জানা যায়। শরহে নুখবাতিল ফিকার কিতাবটি রচনা করেছেন হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ:।
৬। তাফসীরে বায়যাবী( তাফসিরুল কোরআনের নীতি শাস্ত্র)।
লেখক: আল্লামা কাযী নাসীরুদ্দীন আল বায়যাবী আশ শাফেয়ী রহ:।
৭। শরহে আকাইদ (আকাইদ শাস্ত্র)।
আকীদা বিশ্বাস স্বচ্ছ না হলে আদর্শ মুসলিম হওয়া যায় না। ইলমুল আকায়েদ বা ছহীহ ঈমান আকীদা সম্পর্কে সর্বপ্রথম “ আল-ফিকহুল আকবর ” নামে একটি বিরল কিতাব লিখেন ইমামে আযম আবু হানীফা রহ:। পরবর্তীতে অনেকেই এ সম্পর্কে অনেক কিতাবাদি লিখেছেন, আজ থেকে প্রায় এগারশত বৎসর পূর্বে শাইখ নাজমুদ্দীন উমর বিন মুহাম্মদ নাসাফী রহ . আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা সম্পর্কে “মতনুল আকাইদিন নাসাফিয়্যাহ ‘ রচনা করেন এবং পরবর্তীতে আল্লামা সা’দুদ্দীন মাসউদ বিন উমর তাফতাযানী রহ . শরহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যাহ নামে উক্ত রচনাটির বিস্তারিত ব্যখ্যা বিশ্লেষন পেশ করেন। গ্রন্থটি মুসলিম বিশ্বের উলামা মাশায়েখদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভারত উপমহাদেশে কিতাবটি সকল মাদরাসার নেছাবভূক্ত।
৮। ফেরাকে বাতিলা (ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ)। কিতাবটিতে স্বদেশী বাতিল আকীদা পোষণকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে।
৯। তাহরীকে দেওবন্দ (ইতিহাস)
তাহরীকে দেওবন্দ বা দেওবন্দ আন্দোলনের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অবদান নিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত একটি ইতিহাস বিষয়ক বই। লেখক: ড.মাওলানা মুশতাক আহমদ।
আরো পড়ুন: দাওরায়ে হাদীসের কিতাব পরিচিতি
ধন্যবাদ আমার ইশতিহারের সাথে থাকায়। আজকের প্রবন্ধ থেকে আমরা কওমি মাদ্রাসার দরসে নিজামীর মেশকাত জামাতের কিতাব সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম। আটটি বিষয়ে মোট নয়টি কিতাব পাঠদান করা হয়।