জীবনে কত চিঠি লিখেছেন প্রিয় মানুষের কাছে। চিঠিতে প্রকাশ করেছেন কত আনন্দ-বেদনার কথা। কিন্তু কোনো দিন কি রাহমাতুল্লীল আলামীন নবীজির কাছে চিঠি লিখেছেন? বলেছেন আবেগ অনুভূতির কথা কখনও? না লিখে থাকলে আজই লিখে ফেলুন প্রিয় নবীজির কাছে চিঠি। এটি একটি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নবীজিকে উদ্দেশ্য করে লিখিত একটি চিঠির নমুনা দেখুন। লিখেছেন তাজুল ইসলাম মিসবাহ।
আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাল্লাহ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
হে রাসূলে খোদা! হাবীবে কিবরিয়া! সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন! খাতামুন্নাবিয়্যিন! রাহমাতুল্লীল আলামীন! নূরে আলম! রাহবারে জীন ও ইনসান!
ওগো প্রিয়তম! প্রাণের নবী ও প্রেমের নবী!
হে প্রিয় বাশির! মানবকুলের শ্রেষ্ঠমানব! সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মনিষী! মহানস্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি ও নেয়ামত! বিশ্বমানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অবিসংবাদিত মহানায়ক! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক সাধক ও শোধক! সংগঠক, সমাজসংস্কারক ও সফল রাষ্ট্রনায়ক! রণাঙ্গনের নির্ভিকযোদ্বা, সেনাপতি ও সমরবিদ! অন্ধকারযুগের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা! রূপ ও গুণ রাজ্যের সম্রাট! অপরূপ বসুন্ধরার অহংকার ও প্রাণপ্রিয় ব্যাক্তিত্বের অধিকারী! মুসলিমজাহানের হৃৎস্পন্দন! সত্য ও সুন্দর ধর্মের প্রচারক! চির-প্রশংসাপ্রাপক! অদ্বিতীয়, অনুপম, অপ্রতিদ্বন্দ্বী হে মহামানব মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)! তোমার উপর ও তোমার সকল বিশ্বাসী পরিবার-পরিজনের উপর লাখো-কোটি দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক।তোমার তরে এ অধমের জীবন শতবার উৎসর্গ হোক।
হে রাসূলে আরাবি!
সুদূর বাংলা থেকে তোমার এক আজমী প্রেমী!
দেয়ালে ঝুলানো বর্ষপঞ্জীটা জানান দিচ্ছে যে, চলতি মাসটি রবিউল আউয়াল।চারপাশ থেকে ভেসে আসছে চির-চেনা এক গুণগুণ রব।এদিকে হৃদয় বীণাতেও বাজিতেছে নিদারুণ সুরতরঙ্গ।পরমুহূর্তে মনে আসলো এটাতো সেই মাস—যে মাসটি ইসলামের বসন্তকাল।যে মাসে তোমার শুভাগমন হয়েছিলো।শরতের নির্জিব শুষ্ককতার পর বসন্তের প্রাণ-সজীব বায়ু এই ধরায় প্রবাহিত হয়েছিলো।পাপাচার ও মূর্খতার নিকশকালো দীর্ঘরাতের পর সৌভাগ্যের আলোঝলমলে দিনের উদ্ভোধন হয়েছিলো।
তুমি এসেছিলে সমাজের রন্ধ্রেরন্ধ্রে জেঁকে বসা ক্যান্সারের মহৌষধ নিয়ে।মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত দাসসমাজ এবং মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত মানবতাকে উদ্বার করেছিলে।পশুপালের রাখালদের বানিয়েছিলে মানবতার পাহারাদার।এককথায়–অপরূপ-সাজে সাজিয়েছিলে ঘুণেধরা ধরণিটা। কিন্তু,কোনো এক বসন্তকালে এই বিশ্বচরাচরকে কাঁদিয়ে আবার বিদায়ও নিয়েছিলে তুমি অনন্তকালের মহা-সফরে।তাই আজ তোমার আগমনী আনন্দাশ্রু আর বিদায়ী বেদনাশ্রু দিয়ে কালি বানিয়ে লিখতে বসেছি তোমায়।শুনেছি প্রেম নাকি পত্রলিখা শিখায়। হ্যাঁ,আজ বড্ড ইচ্ছে করছে কয়েকদিস্তা কাগজজুড়ে লিখি তোমায় ঘিরে হৃদয়ের যত আকুতি-অনুভূতি।
হে তাজেদারে মদিনা!
তোমাকে ভালোবাসি, হৃদয়ের গহীনস্হ অস্পৃশ্য অবিনশ্বর রূহ থেকে বাসি পৃথিবীর সবকিছুরচে’।প্রাণের চেয়েও! কেনো ভালোবাসবো না বলো! অথচ, তোমার ভালোবাসা আমার রূহ।আমার গোটা অস্তিত্বজুড়ে তুমি। তুমিতো এমন একজন যাঁকে ভালো না-বাসিলে ঈমানে পূর্ণতা আসেনা।তোমাকে কি ভালো না-বেসে পারি? যার মাধ্যমে লাভ করলাম মুমিন হওয়ার মহা-সৌভাগ্য।পেলাম কোরআনের মতো মহা-সম্পদ ও দোজাহানের সফলতার সুপথ।সেপথ দেখাতে যেয়ে যাঁর রক্তঝরলো, দন্তমোবারক শহীদ হলো; তাঁকে তো ভালোবাসতেই হবে।যাঁর প্রয়োজন দুনিয়াতে, কবরে ও হাশরে, মিজান এবং কাওসারে,যাঁর সুপারিশবিহনে জান্নাত অকল্পনীয়—তাঁকেতো ভালোবাসতেই হবে।
যে কিনা সেই হাজারবছর পূর্বে আমার জন্য কেঁদেছে, দোয়া করেছে—তাঁকেতো ভালোবাসতেই হবে।তাঁকে ভালোবাসা ছাড়া ও তাঁর অপরিশোধ্য ঋণস্বীকার করা ছাড়া সভ্যমানুষ হবো কীভাবে?
হে প্রিয় আহমদ!
যুগেযুগে প্রেমিকরা তোমার প্রেমের কত বিস্ময়কর নজির স্থাপন করেগেছে। জানি, আমার ভালোবাসার গভীরতা হবে না তাঁদের মতো।তোমার গুহাসঙ্গী আবু -বকরের মতো।তোমার মৃত্যুসংবাদে তরবারি তাক করা ওমর, বিচ্ছেদব্যাথা সইতে না-পেরে অন্ধত্ব বরণ করা আব্দুল্লাহ বিন-যায়েদ ও প্রাণ হারানো আব্দুল্লাহ বিন উনাইসের মতো।
উহুদে তোমার ঢালরূপী আবু তালহা, তোমার শিরে বিঁধা শিরস্ত্রাণ খুলতে যেয়ে আপন দাঁতভাঙ্গা আবু-ওবায়দা ও মহব্বতের টানে তোমার রক্তপানকারী যায়েদ বিন-সিনানের মতো। বদরে আত্মোৎসর্গী ভাষণে তোমার মুখে হাসি ফোঁটানো নেতাদ্বয় মিকদাদ ও সা’দের মতো। তোমার জঘন্যতম দুশমন আবু-জাহেলকে কতল করা মায়াজ, মুআজের মতো। তোমার শানে কটুক্তি বরদাশত করতে না-পেরে শহীদ হওয়া ভারতের ইলমুদ্দিন ও বাংলার ভোলায় নিহত চারশহীদের মতো। এমনকি আমার ভালোবাসা হবে না তোমার বিচ্ছেদে কান্নাকরা নিষ্প্রাণ উসতুনে হান্নানার মতোও। এঁদের ভালোবাসার পাথুরেপর্বতের সামনে আমার ভালোবাসাতো ক্ষুদ্র বালিটিলা। যাহোক, তবুও বলি তোমায় ভালোবাসি। বালিদিয়ে হলেওতো এহৃদয়ে প্রেমচিন্হ এঁকেছি। প্রেমহীন শুষ্কহৃদয় নিংড়িয়ে ভালোবাসার প্রয়াস চালাচ্ছি…।
হে মুহিব,তুমি তোমার প্রেমসাগরের একবিন্দুজল দিয়ে হলেও আমার হৃদয়মরুটা সিক্ত করে দাও!একটুখানি জড়িয়ে ধরে ভালোবাসায় পূর্ণতা দাও!
জানো! তোমাকে ভালবাসি বলেই তোমার প্রতিটি পদচিহ্ন নকলের প্রযত্ন করি। অন্তরে প্রেমলালন করি। প্রমাণ যদি চাও তবে দেখো! তোমার বেশভূষায় আমি—মাথায় টুপি-পাগড়ি,গায়ে পাঞ্জাবি,টাখনুর উপর পাজামা, মুখে বেঁটেমোছ লম্বা দাড়ি, মাথায় খাটো চুল কখনো-বা বাবরি।পবিত্রতা-পরিপাটিতেও তুমি—মিসওয়াক, টিস্যু,সুগন্ধী, সুরমা ও নির্মল জামা। অভিবাদনে তুমি—সালাম, মুসাফাহা, মোআনাকা। বিসমিল্লাহ, দস্তরখান,স্বল্পাহার ও চাটা, মানে—আমার ভোজনকালেও তুমি। মিথ্যা,গালাগাল ও গর্হিতকাজ বর্জন এবং আঘাতে ক্ষমা, অনাহারী, অসুখীর দেখভাল অর্থাৎ নৈতিকতা ও মানবতাতেও তুমি।ডান-বাম ব্যবহারেও তোমার রীতিনীতি।মোদ্দাকথা,তোমার প্রতিটি সুন্নত অনুসরণের প্রাণপণ চেষ্টাকরি হে রাসুল!
আর তোমার প্রেমে মনেরটানে প্রতিদিন এ-রসনাকে শতবার সিক্ত করি।কবিতা লিখি। নাতগাই। সীরাত পড়ি, আর তোমার জীবনের বেদনাময় মুহূর্তগুলো পড়ে-পড়ে অশ্রুজলে গালভেজাই। তোমার অনুসরণ করতে যেয়ে সমাজের নানান মানসিক নির্যাতন সয়ে যাই। এসব কেনো জানো? কেবল তোমার একটু স্নেহভরা-প্রেমময় দৃষ্টিলাভের আকুল আকাঙ্ক্ষায়।
হে আরব সূর্য!
তোমার জীবন থেকে আমি অনেক নীতিশাস্ত্র শিখেছি। এ হৃদয়ে তোমার আবির্ভাব, আমার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তোমার বড়ত্বতা, পবিত্রতা, সৌন্দর্যতা, সততা, উদারতা, বদান্যতা,নীরবতা, রাগ,কান্না-হাসি,ক্ষমা, সাহস,নেতৃত্ব সবকিছুই আমাকে বিমোহিত ও প্রভাবিত করেছে। কেবল যে আমাকেই এমন নয়।অধুনা পৃথিবীর কোটিকোটি মানুষ আজ তোমার গুণেমোহিত, প্রভাবিত। যে কারণে আজও তোমার আলোচনা আকাশ্চুম্বী। স্রষ্টানামের সাথেসাথে সুউচ্চ মিনারচূড়া থেকে প্রতিমুহূর্তে বাতাসে-বাতাসে ভেসে আসে ‘মুহাম্মাদ’ ‘মুহাম্মাদ’। জানো? তোমার কন্ঠনিঃসৃত একেকটি কথা সংগ্রহ-সংকলন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজে সারাটা জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে বুখারী আর মুসলীমরা। তোমার কথাগুলো থেকে বিধি-বিধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে জীবনটা বিলিয়েদিচ্ছে আবুহানীফা ও শাফেয়ীরা। তোমার জীবনবৃত্তান্তের উপর লাখোলাখো গ্রন্থরচনা করে যাচ্ছে ইবনে ইসহাক ও হিশামরা। তোমার শানে লেখে-গেয়ে জীবনোৎসর্গ করে দিচ্ছে মহাকবি রুমি,সাদী ও জামীরা। কিন্তু, আজ তোমার দুশমন আবু-জেহেলদের নাম-নিশানা ধূলিধূসরিত।এদের নাম মুখে নিলে মানুষ থুতু ফেলে।
হে আয়িশা’র রাত্রিসূর্য!
সবুজ গম্বুজের ছায়াতলে কেমন আছেন জানিনা।তবে হৃদয় বলছে আজ তুমি বেশ বিষন্ন।কারণ দিকেদিকে উম্মতেরা যে আজ নির্যাতিত।আর উম্মত নির্যাতনে ভোগলে তুমি দরদী নবী স্বর্গে থাকলেওতো অসুখী।তুমি উম্মত নিয়ে কাঁদতে, ভাবতে। কিন্ত, আজ উম্মত নিয়ে কাঁদার, ভাবার মানুষের বড্ড অভাব।কাঁন্না-ভাবনা সব আজ আত্মকেন্দ্রিক…।
হে সরকারে মাদিনা!
বছরে-বছরে এদেশ থেকে প্রেমিকরা দল বেঁধেবেঁধে যায় তোমার কাছে।তোমার স্পর্শধন্য ঐ আরবে।কাছথেকে জানায় তোমায় সালাম।করে প্রেমালাপ।জানো রাসূল?
আমারও খুব ইচ্ছেকরে মরু-আরবের ওই কালো ও সবুজঘরের সান্নিধ্য পেতে।কিন্তু, ইচ্ছের সাথে যে ভাগ্যের মনোমালিন্য…।
হে নুরুলহুদা!
মন যে হাজারোকথা বলতেচায়।কিন্ত এভাবে গোনাগোনা শব্দে কতটুকুই-বা আর বলাযায়! তাই আজ এখানেই ইতি টানছি।মুলাকাত যদি হয় প্রাণখোলে বলবো! তবে বিদায়ি সম্ভাষণে তোমার চরণে আকুল মিনতি,কালের আবর্তে যেহেতু হয়েছি অনুজ,হয়নি তোমার মজলিসে বসা,পাইনি কোমল হাতের ছোঁয়া।তাই অনুগ্রহপূর্বক কোনোএক কৃষ্ণরাতে আমার ঘুমঘরে আসিও।কুঁড়েঘর আমার তোমার নূরে আলোকিত করিও।খুশবোতে সুভাশিত করিও। আর মরণকালে সান্ত্বনা দিয়ো। কবরে পাশে থাকিও।
হে শফিউল মুযনিবীন!
সেই ভয়াবহদিনে এঅধমের হাতখানা ধরে পার করিও।
হে কাউসারওয়ালা!
কাউসার থেকে একপেয়ালা শরাব বিলায়ো।
তবেই হবে গো সার্থক জনম আমার…।
‘দে মুঝে ইশকে মুহাম্মদ,আওর মুহাম্মদিঊঁ মেঁ গিন
হু মুহাম্মাদ হী মুহাম্মাদ, বিরদে মেরা রাতোদিন’।
ইতি
তোমার জনৈক নগণ্যপ্রেমিক।