প্রিয় পাঠক, আজকের এই আর্টিকেল থেকে আপনি ‘ঠোঁট কাটা তালু কাটা শিশুর চিকিৎসা কখন কোথায় কীভাবে করাবেন’ ‘ঠোঁট কাটা সার্জারি করতে কত টাকা লাগে’ ‘ঠোঁট কাটা শিশু কেন হয়’ এসব বিষয়ে ধারণা পাবেন। আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি আপনাদের কাছে শেয়ার করব।
আমি মিসবাহ!
বিয়ের কয়েকমাস পর আমার সহধর্মিণী আমাকে সুসংবাদ দেয় যে, ‘জানেন, আমি না মা হতে চলেছি আর আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন’। এ সুসংবাদ শুনে হৃদয়টা অনন্দে ভরে গেল। দিন যত যাচ্ছে অনাগত সন্তানকে দেখার ও স্পর্শ করার আগ্রহ তত বেড়েই চলছে। প্রথম সন্তানের অভিভাবক হওয়ার অনুভূতি কেমন তীব্র হয় তা কেবল নবীন জনক -জননীই জানে।
আমি চাকুরির জন্যে ঢাকাতে থাকতাম। ফ্যামিলি বাড়িতেই (হবিগঞ্জ [বাহুবল]) থাকত। প্রিয়তমা তখন আসন্ন প্রসবা। মাসিক ছুটি কাটিয়ে মাত্র পাঁচদিন আগে বিদায় নিয়ে এসেছি। ষষ্ঠদিন হঠাৎ খবর পেলাম যে তার প্রসবের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। সারাদিন অপেক্ষা শেষে আমার শ্বাশুরী মা তাকে হবিগঞ্জের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক জরুরি চিজার করতে পরামর্শ দেন। চিজারের খবর পেয়েই আমি ইমার্জেন্সি ছুটি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমি বারবার অনুরোধ করছিলাম নরমাল ডেলিভারি করা যায় কিনা, কিন্তু ডাক্তার সোজা বলে দিলো চিজার লাগবেই। তাই অনোন্যপায় হয়ে চিজার করাতে রাজি হইলাম। ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ ছয়-সাত ঘন্টার রাস্তা। আমি হসপিটাল উপস্থিত হয়ে ভর্তি করানোর মতো সময় হাতে নেই। তাই চিজারের জন্যে হসপিটালে ভর্তি হয়ে যেতে বললাম।
গাড়ি ছুটছে গন্তব্যের দিকে। আজকের এই সংবাদটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একদিকে অনাগত বাচ্চার আগমনী খুশি, অন্যদিকে পীড়িত প্রিয়তমার জন্যে ব্যথিত।
আমি যখন হবিগঞ্জের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি তখন ছোট আপু কল দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সুসংবাদটি জানাল যে, তোর ছেলে সন্তান হয়েছে। আমি আনন্দের আতিশয্যে বাসের ভিতরেই উচ্চাওয়াজে শুকরিয়া জানালাম আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপু যখন সুসংবাদটা দিচ্ছিল তখন তার কন্ঠের মধ্যে আনন্দের সুর ছিল না। কান্নাভাব ছিলো। তখন আমার ভিতরে উদ্বেগ সৃষ্টি হলো। জিজ্ঞেস করলাম, আপু তুমি কাঁদছো নাকি? বলে, না কাঁদছি না, আমার প্রেসারটা বেড়ে গেছে। এ বলে কল কেঁটে দিলো।
পরে মেজো আপার কাছে কল দিলাম, সেও কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, তুই পুত্র সন্তানের বাবা হইছস আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তুরে ভাই একটা খুঁত নিয়ে দুনিয়াতে এসেছে আমার ভাইপো। এবার আঁতকে উঠলাম। আমার সুসংবাদ যেন ক্রমশ দুঃসংবাদে পরিণত হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপু কী সমস্যা বলো। আপু বলল, তুই আয়, আসলে পর নিজেই দেখতে পাবি। শরীর যেন বরফ শীতল হয়ে গেছে। অজানা আতংক নিয়ে ছুটতে লাগলাম ‘মাদার কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার হবিগঞ্জ’ এর দিকে। চারতলাতে যাওয়ার পর আমার সম্বন্ধি ও বোন জামাইয়ের সাথে দেখা হলে তারা আমাকে নিয়ে যান আমার নবাগত বাচ্চার কাছে।
রুমে ঢুকে বাচ্চার দিকে তাকাতেই আমি থ হয়ে গেলাম। এ আমি কী দেখছি! আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, এ বাচ্চার দেখছি ঠোঁট কাটা। মাড়ি কাটা। তাকিয়ে দেখি আমার বোন, ভাবি, শ্বাশুড়ি সবার চোখে জল।
আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এটি আমার সন্তান। আমি জিজ্ঞেস করলাম সবাইকে এটা কি আমারই সন্তান? তোমরা কি নিশ্চিত? নাকি উল্টাপাল্টা লেগে গেল? সবাই বলে হ্যাঁ, এটা আমাদেরই বেবী।
আমি আসলে কোনোদিন ভাবিইনি যে আমার ঘরে এমন সন্তান জন্ম নিবে। কারণ, আমাদের বংশে এমন কারো ছিল না। আমাদের এলাকাতেও এমন কারো দেখিনি। আমি যেন একদম ভেঙে পড়লাম।
পরে নিজেকে আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। ছবর করার চেষ্টা করি। তাকদীরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখার সাথে সাথে তাতে সন্তষ্ট হওয়ার চেষ্টা করি। ভেবে দেখলাম, আল্লাহ তায়ালা আমাকে সন্তানের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন নি, আমাকে একটা সন্তান দিয়েছেন। বাবা হওয়ার নেয়ামত দান করেছেন। অথচ সন্তানহীনতার বেদনা নিয়ে জীবন পার করতে দেখেছি বহু দম্পতিকে। কী পাইনি তা না দেখে কী পেয়েছি তা দেখা দরকার। চমৎকার একটি ঠোঁট পাইনি, নিখুঁত একটি মাড়ি পাইনি।ব্যস এটুকুইতো, অথচ পূর্ণাঙ্গ দুটি হাত আছে, দুটি পা আছে, দুটি চোখ আছে, পেট আছে পিঠ আছে, সবইতো আছে। পেলাম তো অনেক কিছু, অতিঅল্প কিছুর না পাওয়ার কারণে মন খারাপ করা উচিত না। যাইহোক, তারপর বাবুটাকে কোলে নিলাম। বুকে নিলাম। আদর দিলাম। দোয়া দিলাম। গায়ের রঙ ও গঠনসহ সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো বাট ঠোঁট কাটার কারণে একটু অদ্ভুত ও বেমানান লাগছিল।
বাচ্চার মা সিজার শেষে রেষ্ট রুমে ছিলো৷ কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে। সেও নির্বাক। বুঝতে পেরেছি তারও মন খারাপ। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলাম। সাহস দিলাম। হাসপাতালের কিছু মানুষ আমাদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো। যেন আমরা অভিশপ্ত। বাড়িতে আসার পর সমাজের মানুষও গোপনে গোপনে কুমন্তব্য করতে লাগল।
অনেকেই বলতে লাগলো, এগুলো চন্দ্র গ্রহণ ও সূর্য গ্রহণের প্রভাব। কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এগুলো বিশ্বাস করি না।
(Orofacial Clefts) জন্মগত ঠোঁট কাটা শিশু কেন হয় তালু কাটা শিশু কেন হয় বিষয়টি জানতে একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলাম। তিনি বললেন,
“প্রথমত বলব: ঠোঁট কাটা তালু কাটা সমস্যা কেন হয় এখন পর্যন্ত এর নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় নি।
দ্বিতীয়ত: গর্ভাবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণের কারণে এমন হতে পারে।
তৃতীয়ত: গর্ভবতী নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে এমন হতে পারে।
চতুর্থত: বংশগত কারণে এমনটা হতে পারে।
পঞ্চমতঃ বাচ্চা যখন মায়ের পেটে ছিল তখন পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়নি। শেষ কথা হচ্ছে, অন্যান্য রোগের মতোই এটিও একটি রোগ, তবে এ রোগটি জন্মগত হয়ে থাকে। কোনো অভিশাপ থেকে নয়। সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় দুই লক্ষ শিশু ঠোঁট কাটা তালু ফাটা নিয়ে জন্মায়”।
আমি উপরোক্ত সবগুলো লক্ষ্মণ মিলিয়ে দেখলাম প্রথম কারণেই এমনটা হয়েছে।অর্থাৎ অনির্দিষ্ট কারণে। আনির্দিষ্ট কারণের ব্যাখ্যা হিসেবে আমি ধরে নিয়েছি ‘আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন তাই এমন হয়েছে’।
ছেলেটার দুধপান করতে কষ্ট হচ্ছিলো। মুখে ভালোভাবে স্তন্যপান করতে পারছিল না। বিষয়টা দেখে খারাপ লাগছিলো তাই খোঁজ করতে লাগলাম কোথাও ঠোঁট কাটা তালু কাটা শিশুর চিকিৎসা আছে কিনা। গুগলে সার্চ করলাম ‘ঠোঁট কাটা তালু কাটা শিশুর চিকিৎসা’ লিখে। রেজাল্টে দেখলাম ‘ঠোঁট কাটা, তালু কাটা ও জন্মগত সমস্যা সাপোর্ট গ্রুপ বাংলাদেশ’ নামে একটি গ্রুপ সামনে আসল। গ্রুপটিতে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমি একদম সঠিক লিংকে প্রবেশ করেছি। আমার যত ইনফরমেশন দরকার সবই এতে আছে। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম বিনামূল্যে ঠোঁট কাটা চিকিৎসার সুবিধা দেখে। কারণ, আমার মতো মধ্যবিত্তের পক্ষে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানোটা বেশ কঠিন ছিলো। যাইহোক, আমি আমার বাচ্চার বিবরণ দিয়ে সে গ্রুপে পোস্ট করলাম। ফয়সল মোহাম্মদ ও রিদওয়ানুর রহমান ভাই কমেন্টবক্সে চিকিৎসা সংক্রান্ত অনেক তথ্য দিলেন। তাদের কাছ থেকে আমি যেসব তথ্য পেয়েছিলাম—
জন্মগত কাটা ঠোঁট ও ফাটা তালু রোগীদের সকল প্রকার ঔষধ ও হাসপাতালে থাকা খাওয়াসহ বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়।
চিকিৎসা গ্রহণের সময় হচ্ছে—(শিশু শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে) তিন মাস বয়স থেকে কাটা ঠোঁট অপারেশন করা হয়। ছয় থেকে নয় মাস বয়সে ফাটা তালু চিকিৎসা করা হয়, চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে নাকের ত্রুটি ঠিক করা হয়, ছয় থেকে সাত বছর বয়সে ফাকা মাড়ির ত্রুটি ঠিক করা হয়। চোদ্দ থেকে পনেরো বছর বয়সে উঁচু নীচু দাঁত ঠিক করা হয়।
অপারেশন করবেন আমেরিকার হাভার্ড মেডিকেল থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিশু কিশোর প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক ডাক্তার বি.কে দাস (বিজয় কুমার দাস)। বিভাগীয় প্রধান, শিশু সার্জারি বিভাগ, কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
সেবা প্রদানের স্হান:
ডেল্টা হেলথ কেয়ার চিটাগাং লিমিটেড।২৮ কাতাইলগঞ্জ,মির্জারপুল,পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।
কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে, কলেজ গেইট, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
এটি নিউ ইয়র্কের ‘স্মাইল ট্রেন’ (Smile Train) এর একটি শাখা। স্মাইল ট্রেন প্রায় দুই দশক ধরে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে জন্মগত ঠোঁট কাটা ও তালুকাটা মানুষের মুখের গড়ন ঠিক করে তাদের মুখে হাসি ফুটানোর কাজ করে যাচ্ছে।
এরপর থেকে মাইমুনের (আমার বাবুর) তিনমাস বয়স হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। হঠাৎ একদি মাইমুনের আম্মু বলল, ‘জানেন? আজ না বাবুর তিনমাস পূর্ণ হয়েছে’।
সাথে সাথে রিজওয়ানুর রহমান ভাইকে নক করলাম। ভাই বললো, বাচ্চার ওজন কত? বললাম, ওজন মাপাইনি, মেপে জানাবো। দুদিন পর জানালাম, ভাই! বাচ্চার ওজন ৪ কেজি, বললেন, ৫ কেজি হলে জানাইয়েন। ৫ কেজি ওজনের সময় অপারেশন করালে ভালো হবে।
আবারো অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন চার মাস পূর্ণ হলো তখন আবার ওজন মাপলাম। এবার দেখলাম ৫ কেজি ৬শ গ্রাম হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তো আবারও নক করলাম রিজওয়ান ভাইকে। বললাম বাচ্চার ওজন পাঁচকেজির অধিক হয়েছে। তো তিনি বল্লেন: ঠিক আছে, আপনি বাচ্চার সমস্ত ইনফরমেশন দেন। আমি সব তথ্য দেবার পর জানালেন, “আপনার বাচ্চার অপারেশন এর রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ, আপনি আগামী শনিবার বিকেল পাঁচটায় ঢাকার কেয়ার মেডিক্যাল হসপিটাল এ উপস্থিত থাকবেন। সাথে বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন এর ফটোকপি নিয়ে যাবেন। আর বাচ্চার সাথে একজন থাকা যাবে। কেয়ার মেডিক্যাল হসপিটাল, কলেজ গেট , মোহাম্মদ পুর ঢাকা, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অপজিটের বিল্ডিংয়ে। ৩য় তলায় যাবেন, ধন্যবাদ।
কথামতো শনিবার সকাল দশটার দিকে, মাইমুন, মাইমুনের আম্মু ও তার নানুকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে ”ঠোঁট কাটা, তালু কাটা ও জন্মগত সমস্যা সাপোর্ট গ্রুপ বাংলাদেশ’ এ পোস্ট করলাম ‘বাচ্চাকে নিয়ে আজ কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছি, সবার দোয়া চাই”। বিকেল তিনটার দিকে মহাখালী বাস্ট্যান্ড এ নামলাম। সেখান থেকে সিএনজি করে মুহাম্মদপুর কেয়ার মেডিকেলের সামনে চলে গেলাম (অবশ্য ইতিপূর্বে এসে হাসপাতাল ভিজিট করে গিয়েছিলাম যেন পরিবার নিয়ে আসা সহজ হয়)। তখন বেলা ৪টা। এখনো দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দুপুরের খাবার খেয়েই আমরা হাসপাতালে প্রবেশ করব। কেয়ার মেডিকেলের দক্ষিণ দিকে খুব কাছের একটা রেষ্টুরেন্ট-এ খাবার দাবার সেড়ে নিলাম। তারপর লিফটের ২য় (সিঁড়ির ৩য়) তলায় উঠে গেলাম। উঠার পর দেখি, ওমা, এখানে দেখি সব বাচ্চা আমার বাচ্চার মতই। কোনো বাচ্চার ঠোঁট কাটা, কারো বা তালু কাটা, কারো ঠোঁট কাটা তালু কাটা দুটোই। এমনও অনেক দেখলাম ঠোঁট কাটা তালু কাটা সাথে মাড়িও কাটা। ঠোঁট কাটা অতিরিক্ত হওয়ার কারণে অনেক বাচ্চাকে প্রথম দেখাতে ভয় পেয়েছিলাম।
যাইহোক অনেক অভিভাবকদের সাথে পরিচয় হলো। বাচ্চাকে নিয়ে তাদের আবেগ অনুভূতির কথা শুনলাম। পুরাতনদের থেকে বিভিন্ন ধারণা পেলাম। আসলে এখানে আসার পর মনটা অনেক হালকা হয়ে গেছে। দেখলাম সমস্যা শুধু আমার বাচ্চারই না দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত বাচ্চার এমন সমস্যা আছে। প্রতি বছর শতশত বাচ্চা ঠোঁট কাটা তালু কাটা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
বিকেল ছয়টার দিকে রবিন ভাই আসল। রবিন ভাই হচ্ছে বিকে স্যারের পি এস। রবিন ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। বললাম সিলেট থেকে রিদওয়ান ভাই আমাদের পাঠিয়েছেন। তখন তিনি বাচ্চার ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ করলেন। বচ্চার নিবন্ধন অনুযায়ী নাম ও জন্মতারিখ লিখলেন। তারপর বললেন আপনারা ওয়েট করুন। স্যার আসলে আপনাদের ডাকবো। বসে অপেক্ষা করছি এমতাবস্থায় রেজওয়ান ভাই একটা মেসেজ করলেন। বললেন, ‘ফেসবুক গ্রুপ খুলেছি আজ প্রায় তিনবছর হয়েছে, কিন্তু বিকে স্যার কোনোদিন কমেন্ট করেন নি। আজ ফাষ্ট আপনার পোস্টে কমেন্ট করেছেন’। দ্রুত নোটিফিকেশন চেক করে দেখলাম সত্যিই স্যার কমেন্ট করেছেন ‘Most welcome’। এটা দেখে অনেক ভালো লাগলো। Bijoy krishna Das স্যারের আইডির নাম।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে স্যার আসলেন।পুরাতন রোগীদের দেখার পর আমাদের সিরিয়াল আসল। বাচ্চাকে নিয়ে আমি আর ওর মা ভিতরে প্রবেশ করলাম। জিজ্ঞেস করলেন কি সমস্যা? আমি বললাম বাবুটার ঠোঁট কাটা। আমাকে চুপ থাকতে বললেন। বাচ্চার মা-ই সব উত্তর দিবে। এবার তিনি বাচ্চার মুখে শক্ত করে একটা চাপ দিতেই বাচ্চা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। ফলে তিনি খুব সহজেই মুখের অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা সেটা দেখে নিতে পারলেন। দেখার পর হাসপাতালে ভর্তি দিলেন। ভর্তির জন্যে কয়েকটি ফরম ফিলাপ করতে হয়েছে। যেটিতে আমার ও আমার স্ত্রীর ঠিকানা স্বাক্ষর ও মোবাইল নাম্বার চাওয়া হয়েছে এবং এই শর্তে অনুমতি চাওয়া হয়েছে যে, পূর্ণ সতর্ক থাকা সত্ত্বেও যদি চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায় তাহলে কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও স্মাইল ট্রেন দায়ী নয়। সকল অনুমতি প্রদান করলে বেবীর কয়েকটি ব্লাড টেষ্ট করতে বলা হল। কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফাষ্টফ্লোরে রিসিপশনে এসে ব্লাড দিলাম। বাচ্চার হাত থেকে ব্লাড নিলো। তারপর কানের লতিতে একটি সুই হালকাভাবে ফুটিয়ে রক্ত বের করল। জিজ্ঞেস করলাম এটা কেন করলেন, বলল, এটা হচ্ছে বাচ্চার রক্ত বন্ধ হতে কত সময় লাগতে পারে তা জানার উপায়। টেষ্ট রিপোর্ট কবে বের হবে তা জানতে চাইলে বলা হল আগামীকাল সকাল নয়টার দিকে। দুটো টেস্ট করাতে যে বিল এসেছে তা পরিশোধ করেছে স্মাইল ট্রেন (রবিন ভাই)।
সব কিছু সম্পন্ন করতে রাত দশটা বেজে গেছে। তখন আমাদেরকে চার তলায় বেডে পাঠানো হল। আর বলে দেওয়া হল রোগীর সাথে শুধুমাত্র একজন থাকা যাবে। মানে বাচ্চা আর বাচ্চার মা। তাদের থাকা খাওয়া হসপিটাল থেকেই ব্যবস্থা করা হবে। বেড রুমে যাওয়ার পর দেখলাম এই রুমে সকল ঠোঁট কাটা তালু কাটার নতুন ও পুরাতন রোগীকে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর একটি বিশেষ প্লেটে করে খাবার দিয়ে গেল। বিশেষ প্লেট বলতে একই প্লেটে দুই পদ তরকারি ও ভাত রাখার সিষ্টেম রয়েছে। বাচ্চার মায়ের তো খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বাকি রইলাম আমি আর আমার শ্বাশুড়ি। আমি নিচে নেমে হোটেলটাতে খেয়ে আসলাম এবং শ্বাশুড়ি আম্মার জন্য পার্সেল নিয়ে আসলাম।
এবার রাত্রিযাপনের পালা। আবাসিক হোটেলেই থাকতে হবে। কিন্তু এদিকে মাইমুনের আম্মু বলতেছে সে একা এখানে থাকতে পারবে না। মাইমুনকে একা সামলাতে পারবেনা। মাইমুনের নানুকে থাকতে হবে। লক্ষ্য করে দেখলাম পাশে একটা বেড খালি আছে। চাইলে একজন থাকা যায়। তাই মাইমুনের নানুকে রেখে গেলাম তাদের পাশে। এবার আমি আবাসিক হোটেল খুঁজতে লাগলাম। কলেজ গেইট থেকে গেলাম শ্যামলী এলাকায়। সেখানে একটি আবাসিক হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম। সকাল নয়টায় এসে রিপোর্ট সংগ্রহ করলাম। বলা হল, বাচ্চাকে পানাহার থেকে বিরত রাখুন। দুপুর দুইটায় অপারেশন করা হবে। এই ঘোষণা শুনার পর অনেকটা স্বস্তি বোধ করলাম।
দুপুর বারোটার দিকে বেবীকে অপারেশনের প্রস্তুতির জন্যে আটতলার একটি রুমে নেওয়া হয়। সেখানে ঘন্টাখানেক রাখার পর অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার জন্যে বের করা হল। লক্ষ্য করলাম, মাইমুনের আম্মুর চোখে অশ্রু টলটল করছিল। ঢাকায় আসার দুদিন আগ থেকেই ওর চোখ থেকে মাঝে মধ্যে অশ্রু ঝরতো। মাইমুনকে চুমু খেত আদর করতো আর বলতো আপারেশন করে আমার বাবাটাকে ডাক্তার বেটা কত কষ্ট দিবে! আমার পুতনটার অনেক কষ্ট হবে গো!
ততক্ষণে থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি বাহিরে বসে বসে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি। আল্লাহ তায়ালা যেন নিখুঁতভাবে কাজটা সম্পন্ন করার তাওফিক দেন। আমার মাইমুন যেন আরো দশটা ছেলের মতো হেসে খেলে বড় হয়।
অপারেশন থিয়েটারে একসাথে সম্ভবত পাঁচজনকে ঢুকানো হয়। আমরা ছাড়াও আরো চারজন অভিভাবককে দেখলাম বারান্দায় অপেক্ষা করতেছে। সবার চোখের কোণেই অশ্রু ঝলমল করছে আর মুখে আল্লাহ নাম জপছে। ‘কলিজার টুকরোটা সুস্থ ও সুন্দর মুখাবয়ব নিয়ে বের হবে’ সে আশায় অপেক্ষা করছে।
সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে সোনামানিক বের হওয়ার সময় তত ঘনাচ্ছে। বিকেল দুটো থেকে বাচ্চার মা ষ্টীল দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের খাবারটাও খায়নি। আমি নিচে নেমে নামাজ ও খাবার সেরে এসে আবারো অপেক্ষা করতে লাগলাম।বিকেল চারটার দিকে অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। তারপর বের করে রেষ্ট রুমে নিয়ে গেল। ছুটে গেলাম সোনাজাদুটাকে দেখার জন্যে। আলহামদুলিল্লাহ, ঠোঁট কাটা সমস্যা সমাধান হয়েছে। আমার ছেলেটাকে এখন আমাদের মতই নিখুঁত দেখাচ্ছে।
মাইমুনের এখনো হুঁশ ফিরে নি। ঘুমাচ্ছে। ঠোঁট ও নাকে রক্তের দাগ। নাকের ভেতরেও রক্ত দেখা যাচ্ছে। নার্স বলেছে, দুইঘন্টা পর রেষ্ট রুম থেকে বেড রুমে পাঠানো হবে। কিছুক্ষণ পর তার হুশ ফিরে। হুঁশ ফেরার পরই জোরে জোরে কান্না করতে লাগল। গলাটা ভেঙে গেছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। পুরো দুইঘন্টা ওর মা কোলে নিয়ে পায়চারি করেছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ডাক্তার বললেন, ”এবার বাবুকে খাওয়ান, তবে লিকুইড জাতীয় খাবার হতে হবে’। বাড়ি থেকে ল্যাকটোজেন, ফিডার নিয়ে এসেছিলাম। তবে গরম পানিতো নেই। তাই দ্রুত নিচে নেমে চা ওয়ালার কাছ থেকে একটু গরম পানি নিলাম। কিন্তু সে তো খেতে চাচ্ছে না। কান্না আর কান্না। অনেক চেষ্টার পর একটু খেয়েছে। ডাক্তার বলল, এবার রুমে নিয়ে যান। নার্স রুমে নিয়ে আসল। সাথে সাথে বকশিশ চাইলো। পকেট থেকে কিছু টাকা বকশিস হিসেবে প্রদান করলাম।
মাইমুনের ঠোঁট মুখ আস্তে আস্তে আস্তে ফুলতে থাকে। সে তখন খুব ভীতসন্ত্রস্ত। চোখগুলো বড়বড় করে তাকাচ্ছে। আর খুব কান্না করছে। কাউকে যেন চিনতে পারছে না। শরীরের উপর দুদিন ধরে ধকল যাচ্ছে। গতকাল রাতে হাত থেকে রক্ত দিয়েছে। কান থেকে রক্ত দিয়েছে। সকাল নয়টা থেকে এ পর্যন্ত আট দশঘন্টা যাবত উপবাস। অস্ত্রপাচার হয়েছে। রক্ত ক্ষয় হয়েছে। সব মিলিয়ে অল্পবয়সের ছোট্ট দেহটা খুবই ক্লান্ত জর্জরিত। কান্না করতে করতে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে গেল। রাত এগারোটার দিকে সজাগ হলো। এবার মাশা আল্লাহ একটু ফুরফুরে ঝরঝরে। খানিকটা স্বস্তি বোধ হলে রাতের খাবার সেরে যারযার ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম। আমি চলে গেলাম আমার এক বন্ধুর কাছে রাতে থাকার জন্য।
পরদিন সকাল নয়টার দিকে ডাক্তার এসে আমাদের ওয়ার্ডের অর্থাৎ ঠোঁট কাটা তালু ফাটা শিশুর সার্জারী সম্পন্ন হওয়া অভিভাবকদেরকে ডেকে ছুটি দিয়ে দিল। বল্ল এক সপ্তাহ পর্যন্ত সর্দি জ্বর থাকবে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। যেসব মেডিসিন দেওয়া হয়েছে সেসব ঠিকমতো সেবন করাবেন ও পরিচর্যা করবেন। এ বিষয়ে আমারা ব্যতীত অন্য কোনো কোনো ডাক্তারের সেবা নিবেন না। আর ২১দিন পর পুনরায় সাক্ষাৎ করবেন।
তারপর সবাই ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরাও ব্যাগপত্র গুছিয়ে বের হয়ে গেলাম হাজারো শিশুর মলিন বদনে সোনালি হাসি ফুটানোর কারখানা কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (স্মাইল ট্রেন) থেকে।
বাড়িতে আসার পর মাইমুনকে দেখার জন্যে পাড়া-পড়শি অনেকেই দেখতে এসেছে। দোয়া ও মঙ্গল কামনা করেছে। ঠোঁট কাটা সার্জারি হয়েছে আজ পাঁচদিন হল। আলহামদুলিল্লাহ মাইমুন এখন অনেক সুস্থ। বুকের দুধও পান করতে পারে। সুন্দর করে হাসতেও পারে।
পরিশেষে একটাই কথা, যারা আমার সোনামানিক মাইমুনের মুখে সুন্দর হাসি ফুটিয়েছে, মহান আল্লাহ তাঁদের মুখে চিরকাল হাসি লাগিয়ে রাখুক।
তাজুল ইসলাম মিসবাহ
বাহুবল হবিগঞ্জ।
প্রিয় পাঠক, আশা করি ‘ঠোঁট কাটা তালু কাটা শিশুর চিকিৎসা কখন কোথায় কীভাবে করাবেন’ ‘ঠোঁট কাটা সার্জারি করতে কত টাকা লাগে’ ‘ঠোঁট কাটা শিশু কেন হয়’ তালু কাটা, ঠোঁট কাটা অপারেশন সংক্রান্ত অনেক তথ্য পেয়েছনে। আরও হেল্প প্রয়োজন হলে—
+8801717497742
+8801781764706 এই নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন।