প্রিয় পাঠক, আজকের এই পোস্ট থেকে আপনি জানতে পারবেন বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস ও কওমি মাদ্রাসার ক্লাসের নাম সম্পর্কে। তার আগে আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর জেনে নেই।
প্রশ্ন: কওমি মাদ্রাসায় উর্দু-ফার্সি পড়ানো হয় কেন? উত্তর: কওমী মাদরাসার শিক্ষা মাধ্যম হলাে বাংলা। কিতাব আরবি থাকলেও তা বাংলাতেই পড়ানাে হয়। ফার্সিতে থাকলেও তা বাংলাতে পড়ানাে হয়। আবার ছাত্ররা যদি খুব মেধাবী হয় তবে সরাসরি আরবি – উর্দুতেও পড়ানাে হয়। সেটা ছাত্রদের মেধা ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই করা হয়ে থাকে। কিতাব পাঠ দিতে গিয়ে একজন উস্তাদকে অনেক ভাষার ব্যাখ্যগ্রন্থের ওপর নজর রাখতে হয়। যেমন ধরুন বােখারি শরিফ। এটির পাঠদান করতে হলে একজন উস্তাদকে আরবি শরাহ, উর্দু শরাহ, বাংলা শরাহ এমনকি অনেক সময় ফার্সি শরাহ তথা ব্যাখ্যাগ্রন্থ মুতালাআ বা অধ্যয়ন করতে হয়। সব কিতাবের বেলায় একই অবস্থা বটে। যার কারণে কওমি মাদরাসায় পড়ুয়ারা আরবি, বাংলা, উর্দু , ফার্সি সব ভাষাতেই কিছু না কিছু জ্ঞান অর্জন করে থাকে। কারণ, আমাদের দেশ পর্যন্ত ইসলামি শিক্ষা পৌছতে কয়েক ভাষায় তা ভাষান্তরিত হয়ে এসেছে। মূল পাঠ আরবি। উপমহাদেশে এর প্রচার ঘটেছিল সর্বপ্রথম ফার্সি ভাষায় ভাষান্তর হয়ে। অতঃপর উর্দু ভাষায়, পরে বাংলা ভাষায়। যার কারণে প্রত্যেক ভাষাতেই অনেক কিছু এমন রয়ে গেছে, যা পুরােপুরি বাংলাতে ভাষান্তর হয়নি, যা সম্ভবও নয়। যেমন, সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজি। ইংরেজির সব কিছু বাংলায় রূপান্তর হয়ে গেছে, এমন কেউ বলতে পারবে না। বরং তা সম্ভবও নয় । তেমনি আরবীর বিষয়টিও। দারুল উলুম দেওবন্দ এসব মাদরাসার মূল সূতিকাগার। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে যেসব প্রকাশনী প্রচারিত হয়, তা বেশির ভাগ উর্দুতেই হয়ে থাকে। যার কারণে বাধ্য হয়েই উলামায়ে কেরামকে উর্দু ভাষাতেও কিছু না কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হয়। সুতরাং এককথায় বলা যায়, কওমি মাদরাসার শিক্ষার মাধ্যম হলো আরবি ও বাংলা। প্রাসঙ্গিক প্রয়ােজনার্থে তাদেরকে ফার্সি ও উর্দু ভাষাও আয়ত্ত করতে হয়। তদুপরি যে পর্যন্ত ফার্সি ও উর্দু শেখানাে হয়, সে পর্যন্ত ইংরেজিও শেখানাে হয়।
কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস:
কওমি মাদ্রাসায় যে পাঠ্যক্রমটি অনুসরণ করা হয়, তা এতদঅঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন পাঠ্যক্রম। যাকে বলা হয় দরসে নেজামী। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমটি মূলত ১৬ বছরের। শিশু শ্রেণি থেকে স্নাতক উত্তর পর্যন্ত অত্যন্ত সুন্দর এবং অনন্য অবকাঠামোতেই এই শিক্ষাক্রম প্রণীত। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাত্রদের বয়স বিবেচনা করে কয়েক বছর কমিয়েও পাঠ্যক্রম তৈরী করেছে যা একান্তই তাদের স্বতন্ত্র বিষয়, তা কওমি মাদ্রাসার মূল পাঠ্যক্রম নয়। ১৬ বছর লেখাপড়া করেই একজন ছাত্রকে দাওরায়ে হাদিস পাস হয় । নিম্নে কওমি মাদরাসার সিলেবাসের সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া হলাে। যাতে শিশু শ্রেণী থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক তালিকা দেখানাে হয়েছে।
শিশু শ্রেণী
১.দীনিয়াত (মৌখিক দোয়া-কালাম) ২. আরবি অক্ষর পরিচয় ৩. বাংলা বর্ণমালা ৪ . গণিত (সংখ্যা গণনা) ৫. ইংরেজি অক্ষর পরিচয়।
প্রথম শ্রেণী (ইবতেদায়ী- প্রাথমিক-১)
১. দীনিয়াত ২. ইসলামি তাহজিব ৩. বাংলা ৪. গণিত ৫. আরবি কায়দা। ৬. ইংরেজি ৭.হাতের লিখা।
দ্বিতীয় শ্রেণী (প্রাথমিক ২)
১. দীনিয়াত ও তাজবিদ ২. ইসলামি ফিকহ ও তাহজিব ৩. বাংলা ৪. গণিত ৫. ভূগােল ও সমাজ ৬. উর্দু ৭. আরবি (আমপারা) ৮. ইংরেজি ৯.সাধারণ জ্ঞান।
তৃতীয় শ্রেণী (প্রাথমিক- ৩)
১. দীনিয়াত ও তাজবিদ ২. ইসলামি ফিকহ ও তাহজিব ৩. বাংলা ও ব্যাকরণ ৪. গণিত ৫. ইতিহাস ৬. ভূগােল ও সমাজ ৭. আরবি ৮ . উর্দু ৯. ইংরেজি ও গ্রামার ১০.সাধারণ জ্ঞান।
চতুর্থ শ্রেণী (প্রাথমিক ৪)
১. দীনিয়াত ও তাজবিদ ২. ফিকহ ও তাহজিব ৩. বাংলা ও ব্যাকরণ ৪. গণিত ৫. ইতিহাস , ভূগােল ও সমাজ ও সাধারণ জ্ঞান ৬. আরবি ৭ . কায়েদা ৮. ফার্সি ৯. ইংরেজি গ্রামার ও উর্দু।
পঞ্চম শ্রেণী (প্রাথমিক- ৫)
১. দীনিয়াত ও তাজবিদ ২. ফিকহ ও তাহজিব ৩. বাংলা ও ব্যাকরণ ৪. গণিত ৫. ইতিহাস, ভূগােল ও সমাজ ৬. আরবি ৭. উর্দু ও কাওয়ায়েদ ৮. ফার্সি ও কাওয়ায়েদ ৯. ইংরেজি ও গ্রামার।
ষষ্ঠ শ্রেণী (মুতাওয়াসসিতাহ- নিম্ন মাধ্যমিক-১)
১. আরবি ভাষা ও রচনা ২. আরবি ব্যাকরণ ৩. ফিকহ ৪. বাংলা ও ব্যাকরণ ৫. সমাজ , ইতিহাস ও ভূগােল ৬. গণিত / তাজবীদ, মশক ও মুখস্থ ৭. ফার্সি ও কাওয়ায়েদ ৮. উর্দু সাহিত্য ও ব্যাকরণ ৯. ইংরেজি ও গ্রামার ১০. বিজ্ঞান।
সপ্তমশ্রেণী (মিযান/মুতাওয়াসসিতাহ/নিম্নমাধ্যমিক ২)
১. আরবি ভাষা ও রচনা ২. আরবি ব্যাকরণ (নাহবেমীর) ৩. ইলমুস সরফ ৪. ফিকহ ৫. বাংলা ও ব্যাকরণ ৬. ইতিহাস ও ভূগােল ৭. ফার্সি সাহিত্য ও ব্যাকরণ ৮. তাজবিদ মশক ও মুখস্থ ৯. ইংরেজি ও গ্রামার ১০. গণিত ১১. বিজ্ঞান।
অষ্টম শ্রেণী-নাহবেমীর (নিম্ন মাধ্যমিক- ৩)
১. আরবি ভাষা ও রচনা ২. আরবি ব্যাকরণ (নাহব) ৩. আরবি ব্যাকরণ (মিযানুস সরফ) ৪. ফিকহ(মালাবুদ্দা) ৫. বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণ ৬. ইতিহাস। ও ভূগােল ৭. ফার্সি সাহিত্য ও ব্যাকরণ ৮. তাজবিদ মশক ও মুখস্থ ৯. ইংরেজি ও গ্রামার ১০. গণিত ১১. বিজ্ঞান।
নবম শ্রেণী-হেদায়াতুন্নাহু (মাধ্যমিক -১)
১. আরবি সাহিত্য ও রচনা ২. নাহব (ব্যাকরণ ) ৩. ফিকহ (ইসলামি আইন শাস্ত্র) ৪. উসূলুল ফিকহ (ইসলামি আইনের নীতি শাস্ত্র) ৫. ইতিহাস ৬. আখলাক (নৈতিক চরিত্র) ৭. মানতিক (তর্ক শাস্ত্র) ৮ বাংলা সাহিত্য ৯. বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা। ১০. গণিত ও জ্যামিতি ১১. ইংরেজি ও গ্রামার।
দশম শ্রেণী-কাফিয়া (মাধ্যমিক- ২)
১.আরবি সাহিত্য ও ইনশা ২. নাহব (ব্যাকরণ) ৩. ফিকহ (ইসলামি আইন শা) ৪. উসূলুল ফিকহ (ইসলামি আইন শাস্ত্রের নীতি শাস্ত্র) ৫. তাফসিরুল কোরআন ৬. ইতিহাস ৭. বালাগাত (ভাষার অলংকার শাস্ত্র) ৮. মানতিক (তর্ক শাস্ত্র ) ৯. ইতিহাস।
একাদশ শ্রেণী-শরহে জামি(উচ্চ মাধ্যমিক- ১)
১. আরবি সাহিত্য ২. ইনশা তথা রচনা ৩. বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) ৪. ফিকহ (আইন শাস্ত্র) ৫. উসুলুল ফিকহ ( ইসলামি আইনের নীতি শাস্ত্র ) ৬. তাফসির ৭. ইতিহাস ৮. ইলমুল ফারাইজ ( উত্তরাধিকার জ্ঞানের হিসাব – নিকাশ ) ৯. মানতিক (তর্ক শাস্ত্র)।
দ্বাদশ বর্ষ-শরহে বেকায়া (উচ্চ মাধ্যমিক ২)
১. আরবি সাহিত্য (প্রাচীন ও আধুনিক) ২. ইনশা (রচনা) ৩ . আল অরুজ (আরবি কবিতা শাস্ত্র) ৪. বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র ) ৫ . তাফসিরুল কোরআন ৬. ফিকহ ( আইন শাস্ত্র ) ৭. উসুলুল ফিকহ ( ইসলামি আইনের নীতি শাস্ত্র ) ৮. মানতিক (তর্ক শাস্ত্র )।
ত্রয়ােদশ শ্রেণী-জালালাইন (স্নাতক -১)
১. তাফসির (জালাইন শরীফ ২.ফিকহ(হেদায়া ১-২ খন্ড) ৩. উসুলুল ফিকহ ৪. মানতিক (তর্ক শাস্ত্র ) ৫. উসুলুত তাফসির (তাফসিরের মূলনীতি) ৬. আরবি সাহিত্য ৭. ইসলামি অর্থনীতি ৮. ইলমে হিকমাত (দর্শন শাস্ত্র) ৯. ইলমুল কালাম (আকিদা বিষয়ক শাম্রজ্ঞান )।
চতুর্দশ শ্রেণী-মিশকাত (স্নাতক- ২)
১. হাদিস(মিশকাত শরীফ ২. তাফসির (বায়যাবী শরীফ)৩. ফিকহ (হেদায়া ৩-৪ খন্ড ব্যবসা বাণিজ্য, ফিকহুল মু’আমালাত) ৪. উসুলুত তাফসির (তাফসিরুল কোরআনের নীতি শাস্ত্র ) ৫. উলুমুল হাদিস (হাদীসের নীতি শাস্ত্র ) ৬. ইলমুল কালাম (শরহে আকাইদ)৭. ইসলামি অর্থনীতি। ৮.ইতিহাস(তাহরীকে দেওবন্দ)।
পঞ্চদশ শ্রেণী-দাওরায়ে হাদিস (স্নাতকোত্তর)
এই বর্ষে শুধু হাদিস পড়ানাে হয়। সিহাহে সিত্তা তথা হাদিসের সহিহ ছয় কিতাব, যথা- সহীহ বুখারী শরীফ,মুসলীম শরীফ,তিরমিজি শরীফ,আবু দাঊদ শরীফ,নাসাঈ শরীফ,ইবনে মাজাহ শরীফ,। হাদীসের এই বিশুদ্ধ ছয়খানা কিতাবের সাথে সাথে তাহাবি শরিফ, মুআত্তা মালেক ও মআত্তা মুহাম্মদ এবং শামায়েল পড়ানো হয়। সব মিলিয়ে ১০ বিষয়।
এই ছিল কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস পরিচিতি।
কওমী ধারায় উচ্চশিক্ষা:
উপরোক্ত পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করার পর অনেক শিক্ষার্থী আবার উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকে। তাদের জন্য রয়েছে বিষয়ভিত্তিক উচ্চাশিক্ষার ব্যবস্থা।
• ইসলামি আইন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য রয়েছে ইফতা বিভাগ (তাখাসসুস ফিল ফিকহিল ইসলামি)।
• হাদিস ও হাদিসের নীতি শাস্ত্রের জন্য রয়েছে হাদিস বিভাগ (তাখাসসুস ফি উলুমিল হাদিস)।
• তাফসির ও তাফসিরের নীতি শাস্ত্রের জন্য রয়েছে তাফসির বিভাগ (তাখাসসুস ফি উলুমিল কোরআন)।
• তাজবিদ ও তাজবিদের নীতি শাস্ত্রের জন্য রয়েছে তাজবিদ বিভাগ (তাখাসসুস ফি তাজবিদিল কোরআন)।
• ইসলামি অর্থনীতির জন্য রয়েছে ইকতিসাদ বিভাগ (তাখাসসুস ফি ফিকহিল মু’আমালাত ওয়াল ইকতিসাদিল ইসলামি )।
• আরবি সাহিত্যের জন্য কিসমুল আদব (তাখাসসুস ফি আদবিল আরবি)।
• বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের জন্য রয়েছে বাংলা সাহিত্য ও ইসলামি গবেষণা বিভাগ।
• আধুনিক শিক্ষার জন্য বহু মাদরাসায় এখন কম্পিউটার বিভাগ চালু রয়েছে।
• কিছু কিছু মাদরাসায় বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ বিভাগ রয়েছে ।
প্রকাশনা বিভাগও রয়েছে অনেক মাদরাসায়।
দাওয়াহ প্রশিক্ষণ বিভাগ এবং হস্তশিল্প বিভাগ নামেও রয়েছে স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে।
এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযােগ রয়েছে কওমি মাধ্যমে।
বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কওমি মাদ্রাসার তালিকা দেখে নিন
সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসার ইতিহাস জেনে নিন
(আশা করি আপনি কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম বা কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস এবং কওমি মাদ্রাসার জামাতের নাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন) আমার ইশতিহার।