ইমাম আবু হানিফা রহ: এর জীবনী
ইমাম আবু হানিফা রহ:
ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। হানাফি মাজহাবের ইমাম।
ইমাম আবু হানিফার জন্ম ৮০ হিজরি।
ইমাম আবু হানিফার জীবনকাল: ৭০ বছর।
ইমাম আবু হানিফার মৃত্যু: ১৫০ হিজরী।
জন্ম ও বংশ পরিচয়:
ঐতিহাসিকগণ একমত যে, ইমাম আযম আবু হানিফা রহ, ৮০ হিজরি সনে কুফায় জন্মগ্রহণ করেছেন। ৬১ হিজরি সনের একটি দুর্বল মত রয়েছে। এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁর শ্রদ্ধাম্পদ পিতা শ্রদ্বাস্পদ পিতা ছাবিত ইবনে যূতা ছিলেন ফার্সি। এভাবে তিনি ফার্সি বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁর দাদা ছিলেন কাবুলের লোক। আরবরা সে অঞ্চল জয় করলে তাঁর পিতা ছাবিত বন্দি হয়ে বনি তামিম ইবনে ছা’লাবার দাসে পরিণত হন। এরপর তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন তিনি সে গোত্রের মাওলা/আজাদকৃত দাস আখ্যা পান। মৈত্রিসূত্রে বংশপরিচয়ে তিনি তাইমি। তাঁর নাতি আমর ইবনে হাম্মাদ ইবনে আবু হানিফা এরূপই বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু তার আরেক নাতি আমর ইবনে হাম্মাদের ভাই ইসমাঈল বলেন, তাঁর বংশপরম্পরা হলো —উপনাম আবু হানিফা। পূর্ণ নাম: নুমান ইবনে ছাবিত ইবনে নুমান ইবনে মাযুবান। তিনি বলেন মূলত আমাদের বংশ তখনো দাস ছিল না। নিঃসন্দেহে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দুই নাতি তাঁর বংশপরম্পরা বর্ণনায় ভিন্নমত পোষণ করেছেন। প্রথমজনের মতে ছাবিতের পিতার নাম যূতা। অথচ দ্বিতীয়জন বলেছেন তাঁর পিতার নাম নুমান। এভাবে প্রথমজনের মতে তিনি এককালে দাস ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়জ্ঞান অকাট্যভাবে তা নাকচ করে দিয়েছেন।
ইমাম আবু হানিফার রহ এর শিক্ষাদীক্ষা:
ইমাম সাহেব রহ. কুফায় বেড়ে উঠেন। সেখানেই তাঁর উত্থান। সেখানেই অবস্থান করে জীবনের অধিকাংশ সময় শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান ও বাতিলের সাথে তর্কবিতর্কে অভিবাহিত করেন। তিনি ইলমুল
কুরআন ইমাম আছেম রহ. থেকে শিক্ষা করেছেন। আর ইমাম আছেম রহ. ছিলেন প্রখ্যাত সাত কারীর অন্যতম। ইরাকে ইসলামপূর্ব যুগে বিভিন্ন খ্রিষ্টান সম্প্রদায় পাওয়া যেত। এরা আকিদা-বিশ্বাস
নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করত। ইসলামের আবির্ভাবের পরও ইরাকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকজন একত্র হয়ে যায়। দাঙ্গা-হাঙ্গামার বাজার সরগরম হতে থাকে। রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও নীতি-আকিদার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মতাদর্শ প্রকাশ পেতে থাকে। তাদের মধ্যে ছিল শিয়া সম্প্রদায়। এদের ঘোর বিরোধী ছিল খারিজি সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে ছিল মুতাযিলা সম্প্রদায়। আরো ছিল সাহাবাদের ইলমের কর্ণধার মুজতাহিদ তাবিয়িগণ। সুতরাং ইলমে দ্বীনের স্বচ্ছ নির্ঝরের পরতে পরতে সেখানে বিদ্যমান ছিল পরস্পর বিরোধী বহু মতবাদ ও বিচিত্র চিন্তাধারা।
ইমাম আবু হানিফা রহ. চোখ খুললেন। দেখলেন বিভিন্ন জাতি-ধর্ম ও মতবাদের এক নতুন জগৎ। চিন্তা গবেষণার পর এগুলোর স্বরূপ তাঁর নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল। যৌবনের শুরুতেই তিনি তর্কবাদীদের সাথে
তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ করে দিলেন। নিজের নির্মল প্রকৃতির নির্দেশনা অনুসারে বিদয়াতি এবং পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মাঠে অবতীর্ণ হয়ে গেলেন। তদুপরি তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিলেন। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন: একদিন আমি ইমাম শাবি রহ.-এর নিকট গেলাম। তিনি আমাকে বললেন, অলসতা করবেন না! ইলমের দরস, অধ্যয়ন ও আলেমদের সান্নিধ্য আপনার জন্য অতি জরুরি। কারণ, আমি আপনার ভিতরে অত্যন্ত সজাগ-সচেতনতার লক্ষণ প্রত্যক্ষ করছি। ইমাম সাহেব রহ. বলেন,
তাঁর কথাটা আমার অন্তরে রেখাপাত করল। আমি বাজারে যাতায়াত ছেড়ে দিয়ে ইলম হাসিল শুরু করে নিলাম। আল্লাহ তা’আলা তাঁর উপদেশের মাধ্যমে আমাকে প্রভূত উপকৃত করেছেন।
ইলমের প্রতি মনোনিবেশ
ইমাম শা’বি রহ:এর উপদেশ শুনে ইমাম আবু হানিফা ইলমের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। সম্পর্ক গড়লেন আলেম উলামাদের সাথে। কিন্তু প্রশ্ন হল, তিনি কোন মতাদর্শী আলেমদের প্রতি আকৃষ্ট হলেন? ঐতিহাসিক সূত্রগুলো থেকে প্রতিভাত হয়, তৎকালীন যুগে দরস- তাদরিসের আসরগুলো তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা:
১। উসূল ও আকাইদ বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার আসর। এতে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করত।
২। রাসূলুল্লাহ – এর হাদিছের আলোচনা ও বর্ণনার আসর।
৩। কুরআন-হাদিসের আলোকে ফিক্হি মাসয়ালা ও নিত্য-নতুন যুগ-সমস্যা সম্পর্কে ফতোয়া প্রনয়ণের আসর।
এ প্রসঙ্গে আমাদের সামনে কয়েকটি বর্ণনা রয়েছে। প্রথম বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আযম রহ. যখন ইলম হাসিলের জন্য অনুমনে ধ্যানেজ্ঞানে তৈরি হয়ে গেলেন, তখন তিনি সেকালের সচারচর ও প্রচলিত জ্ঞান, বিজ্ঞান শিক্ষা করার পর ইলমে ফিকহের প্রতি আকৃষ্ট হন। অপর দুটি বর্ণনায় পরিষ্কার রয়েছে, ইমাম সাহেব রহ প্রথমত বিরোধী পক্ষের ইলমে জাদল ও কালাম (তর্কবিদ্যা) হাসিল করেন। এরপর সম্পূর্ণ একাগ্রতার সাথে ইলমে ফিকহ হাসিল করতে আত্মনিয়োজিত হন। অবশেষে একজন বিশ্ববিখ্যাত ফকিহ হয়েই ছাড়েন। তাঁর হাতেই এ শাস্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে। ইমাম আবু হানিফা রহঃ নিজেই বলেন, ‘আমি বাস করতাম ইলম ও ফিকহের রত্নভাণ্ডার কুফায়। আজীবন কুফাবাসীর সঙ্গী-সাথি হয়েই কাটিয়েছি। অবশেষে আমি কুফার ফকিহদের মধ্যে অন্যতম একজন ফকিহ (হাম্মাদ রহ.)-এর আঁচল আঁকড়ে ধরলাম শক্তভাবে।
পদমর্যাদা ও ক্ষমতার প্রতি অনিহা:
আল্লামা মক্কি রহ. বর্ণনা করেন। ইবনে হুবাইরা উমারি শাসনামলে কুফার প্রশাসক ছিলেন। ইরাকে যখন বিশৃঙ্খলা তীব্র আকার ধারণ করল, তখন তিনি ইরাকের উলামা- ফকিহদেরকে নিজ বাসভবনের সম্মুখে সমবেত করলেন। তাঁদের মধ্যে ইবনে আবু লাইলা, ইবনে শুবরুমা রহ. এবং দাউদ ইবনে আবি হিন্দাজও ছিলেন। তিনি প্রত্যেককে এক একটি পদ অর্পণ করলেন। ইমাম আবু হানিফা রহ.-কেও বলে পাঠালেন। তাঁকে তিনি সরকারি মোহর অর্পণ করতে চান। যাতে তাঁর সীলমোহর ছাড়া কোনো অধ্যাদেশ জারি এবং সরকারি কোষাগার থেকে কোনো অর্থ বের হতে না পারে। ইমাম আবু হানিফা রহ. তা অস্বীকার করলেন। ইবনে হুবাইরা তার এ প্রস্তাব গ্রহণ না করলে ইমাম সাহেবের উপর জুলুম-নির্যাতন চালানোর শপথ করল। এ কথা শোনার পর উপস্থিত সমস্ত ফকিহ গিয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ.-কে অনুরোধ করে বললেন, আল্লাহর জন্য নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবেন না। আমরা আপনার সাথি ছিলাম। আমরাও তার পদমর্যাদা গ্রহণকে পছন্দ করতাম না। কিন্তু কী করব বলুন! গ্রহণ করা ছাড়া তো কোনো উপায়ান্ত নেই।
ইমাম সাহেব বললেন প্রশাসক মহোদয় যদি আমাকে ওয়াসেত শহরের মসজিদের দরজা গণনার নির্দেশও দেন, তথাপি আমি তা পালন করতে প্রস্তুত নই। এটা কিভাবে সম্ভব যে, ওনি কাউকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি করবেন আর আমি তাতে সীলমোহর করব!? আল্লাহর শপথ! এমনটি আমি কখনো করব না।
ইবনে আবি লাইলা বললেন, ‘তাঁকে ছাড়ুন! উনি ঠিকই বলছেন। বাকি সবাই ভুলের মধ্যে রয়েছেন’। পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ফেলল। একাধারে কয়েক দিন বেত্রাঘাত করতে থাকল। আরো অনেক অসহ্য নির্যাতন ভোগ করার পর অবশেষে তিনি কারামুক্ত হয়ে নিরাপদে মক্কা মুকাররমা পৌঁছুতে সক্ষম হলেন। এ ঘটনা ১৩০ হিজরির। এরপর আব্বাসি শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তিনি মক্কায় বসবাস করেন। খলিফা আবু জাফর মানসুরের শাসনামলে তিনি কুফায় ফিরে আসেন। আল্লামা মুওয়াফ্ফাক মক্কি রহ. বলেন: খলিফা মানসুর তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। খলিফা মানসুর ক্রুদ্ব হয়ে পড়লেন। জামা-কাপড় খুলিয়ে উন্মুক্ত দরবারে বেত্রাঘাত করালেন। ফলে তাঁর
শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। কিন্তু ইমাম সাহেব-এতদসত্ত্বেও বললেন, আমি এ পদের উপযুক্ত নই। খলিফা তো এবার রাগে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, আপনি মিথ্যা বলছেন! ইমাম সাহেব বললেন এবার তো আপনি নিজেই ফয়সালা করে দিলেন, আমি অযোগ্য। কেননা কোনো মিথ্যুক ব্যক্তিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পদ অর্পণ করা জায়েয নয়।
খলিফা তখন শপথ করে বললেন, আপনাকে অবশ্যই এ পদ গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যুত্তরে ইমাম সাহেরও শপথ করে বললেন, আমি কখনো তা গ্রহণ করব না। ইমাম সাহেবের এ দুঃসাহস ও নির্ভীকতা দেখে পুরো দরবার নির্বাক-স্তব্ধ হয়ে গেল। হাজেব ইবনে রবি’ ক্রুব্ধ হয়ে বলল, আবু হানিফা! তুমি আমিরুল মুমিনিনের বিরুদ্ধে কসম করছ!? ইমাম সাহেব অকুণ্ঠ জবাব দিলেন, আমিরুল মুমিনিনের জন্য কসমের কাফ্ফারা আদায় করা আমার চেয়ে সহজ। খলিফা তো রাগে-দুঃখে স্তব্ধ। ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন। উত্থান-পতনের চিন্তাও ছিল না। তৎক্ষণাৎ খলিফার চাচা আব্দুছ ছামাদ ইবনে আলী ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস খলিফাকে আর সামনে বাড়তে
নিষেধ করে বললেন, এ কি গজব টেনে আনছেন আপনি। তিনি ইরাকের ফকিহ। চাচার এ কথা শুনে খলিফাও বিষয়টির স্পর্শকাতরতা অনুভব করলেন। এর খেসারত হিসেবে প্রত্যেক বেত্রাঘাতের বিনিময়ে
একহাজার দিরহাম অনুপাতে ত্রিশ হাজার দিরহাম ক্ষতিপূরণ দিলেন। সে যুগের হিসেবে এটা বিরাট বড় অঙ্কের উপহার ছিল। কিন্তু এ বিপুল অঙ্কের অর্থ ইমাম আবু হানিফা সাহেবের নিকট আনা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন । কেউ বলল, আপনি নিয়ে দান করে দিন! তখন তিনি ক্রুব্ধ হয়ে বললেন: এদের কাছে কি কোনো হালাল-পবিত্র সম্পদ আছে যে, তা নিয়ে আমি দীন-দরিদ্রদের মাঝে দান করে দিব।
ইমাম আযম আবু হানীফা রহ: রাজা- বাদশাদের উপহার সামগ্রী এভাবেই আজীবন প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিচরপতির পদও বারবার এভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ইবনে হাজার মক্কি বর্ণনা করেন: খলিফা মানসুর ইমাম আযম রহ-কে বিচারপতির আসন গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। বললেন, সমস্ত ইসলামি রাষ্ট্রের সকল বিচারপতি আপনার অধীন থাকবে। কিন্তু ইমাম সাহেব অস্বীকার করলেন। ফলে খলিফা শক্তভাবে শপথ করে বললেন, আপনি এ পদ গ্রহণ না করলে আপনাকে কারাগারে পাঠানো হবে।
চরম শাস্তিও দেওয়া হবে। ইমাম সাহেব এর পরেও অস্বীকার করলেন। কাজেই খলিফাও তাঁকে কারাগারে পাঠালেন। সেখানে তাঁর নিকট এই বলে দূতও পাঠাতে থাকেন যে, তিনি মুক্তি প্রার্থনা করলে মুক্তি দেওয়া
হবে। কিন্তু তিনি বরাবরই উপেক্ষা করতেন। অবশেষে খলিফা আদেশ দিলেন, প্রত্যেহ তাঁকে দশটি বেত্রাঘাত করবে। কথাটা বাজারে বাজারে ঘোষণাও করে দিবে। সুতরাং দশদিন পর্যন্ত তাঁকে দশটি করে বেত্রাঘাত করা হয়।
আবু হানিফা রহ. এর শাহাদাত কোনো কোনো গ্রন্থে লিখা আছে, একদিন একশত বেত্রাঘাত করা হল। ফলে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত
রঙে রঞ্জিত হয়ে গেল। এরপর পাঠানো হল কারাগারে। সমস্ত বিষয়ে, এমনকি পানাহারেও শক্ত কঠোরতা।আরোপ করা হল। দশ দিন পর্যন্ত এ কঠোরতা ও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে। এরপর ইমাম সাহেব ভীষণ কান্নাকাটি ও ব্যথা নিয়ে দুয়া করলেন। এর পাঁচ দিন পরেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে
চলে যান।
একদল তত্ত্ববিদ বর্ণনা করেন। ইমাম সাহেবের খেদমতে একটি পেয়ালা পেশ করা হয়। তাতে ছিল বিষ। ইমাম সাহেব বললেন। আমি জানি, এতে বিষ আছে। আমি আত্মহত্যা করতে চাই না। এতে সাহায্যকারীও হতে চাই না’। তখন জোরপূর্বক তাঁর মুখে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়। বর্ণিত আছে, অজান্তে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়। হতে পারে একবার তিনি বুঝতে পেরেছেন কিন্তু অন্য সময় বুঝতে পারেন নি।
খাইরাতুল হিসান’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, অর্থাৎ, বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত আছে, ইমাম সাহেব যখন মৃত্যুর উপলব্ধি করলেন, তৎক্ষণাৎ সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। আর ইমাম আবু হানিফা রহ. সত্তর বছর বয়সে ১৫০ হিজরিতে সিজদারত অবস্থায়ই শাহাদত বরণ করলেন।
হযরত ইমাম আযম রহ.-এর মৃত্যুর কয়েক দিন পর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ: বাগদাদ আসেন। ইমাম সাহেবের কবর যিয়ারতে গেলেন। অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে বললেন, হে আবু হানিফা, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন। ইবরাহিম মৃত্যুবরণ করেছেন, নিজের স্থলাভিষিক্ত রেখে গেছেন। হাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। নিজের স্থলাভিষিক্ত রেখে গেছেন। কিন্তু আক্ষেপ! আপনি দুনিয়ায় কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত রেখে যান নি।
সমসাময়িক মনীষীদের মন্তব্য
যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে তাঁর বন্দনা প্রশংসার চর্চা চলছে। দিন দিন বাড়ছে এ মহান ফকিহের জীবনকর্মের মূল্য-মর্যাদা। এসব বন্দনাকারী নানা মতবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। কিন্তু মাহাত্ম্য-মর্যাদা সম্পর্কে সবাই একমত ছিল। এ পর্যায়ে আমরা এখানে তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের কতিপয় মনীষীর উক্তি তুলে ধরছি।
১। তাঁর সমকালীন প্রখ্যাত সাধক বুযুর্গ ফুযাইল ইবনে আয়ায রহ. বলেন: ইমাম আযম ইমাম আবু হানিফা রহ: ছিলেন মহান ফকিহ, ধনকুবের, দানবীর, দিনরাত অধ্যবসায়ে লিপ্ত, ইবাদতগুযার, নির্জনবাসে অভ্যস্ত ও মিতভাষী। হালাল-হারামের কোনো বিষয় এলে তিনি অকুণ্ঠ সত্য বলে দিতেন। শাসকদের ধন-সম্পদের প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা।
২। জাফর ইবনে রবি রহ. বলেন: আমি পাঁচ বছর তাঁর খেদমতে কাটিয়েছি। তাঁর চেয়ে স্বল্পভাষী আর কাউকে দেখি নি। ফিকহের কোনো বিষয় জিজ্ঞাসা করা হলে একদম খুলে বলতেন। স্রোতধর নদীর মতো প্রবাহিত হতেন। তাঁর আওয়াজ ছিল উচ্চ ও তীব্র।
৩। তাঁর সমসাময়িক মালিহ ইবনে ওয়াকি’ রহ. বলেন: ইমাম আবু হানিফা রহ. ছিলেন বড় বিশ্বস্ত ও বীরপুরুষ। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সবকিছুর উপর অগ্রাধিকার দিতেন। আল্লাহর পথে তরবারির আঘাতও হাসিমুখে সহ্য করতেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করুন। তাঁর উপর সন্তুষ্ট হন। কেননা তিনি অত্যন্ত সৎ লোক ছিলেন।
৪। তাঁর সমসাময়িক বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ তাঁকে ইলমের সারনির্যাস বলতেন।
৫। ইমাম আবু হানিফা রহ. যখন দোলনার শিশু, তখন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে জুরাইজ র, তাঁর সম্পর্কে বলেন: “ইলমের জগতে তাঁর একটি বিস্ময়কর আসন হবে। ইমাম সাহেব রহ. বড় হওয়ার পর ইবনে জুরাইজ রহ.-এর মজলিশে তাঁর কথা উঠল। তিনি তখন উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, তিনি বড় ফকিহ। তিনি বড় ফকিহ।
৬। কতক সমসাময়িক বলেন, আবু হানিফা যুগের বিস্ময় ছিলেন। তাঁর ইলম থেকে সে ব্যক্তিই বিমুখ হতে পারে, যে তাঁকে চিনতে পারে নি।
৭। তাঁর সমসাময়িক ইমাম আমাশ রহ. বলেন। নিঃসন্দেহে ইমাম আবু হানিফা রহ একজন বড় ফকিহ।
প্রিয় পাঠক, উক্ত প্রবন্ধ থেকে আমরা হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফার জীবনী জানতে পারলাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইমাম আবু হানিফা রহ এর কবরকে জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দিক। তাঁর চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার তাওফিক দিক।